ভাই, একটা টেলিফোন করব।
ভদ্রলোক পিছন ফিরে বললেন, টেলিফোনের চাবি খুলে দাও।
বুড়ো আবারও কাঁপতে কাঁপতে আসছে। টেলিফোনের চাবি তার কোমরের ঘুনাসির সঙ্গে বাঁধা। টেলিফোনের চাবি খুলতে তার দীর্ঘ সময় লাগল। হাত এমনভাবে কাঁপছে যে তালার ফুটোয় চাবি দুকানো যাচ্ছে না। যতবার টেলিফোন করা হয় ততবার কি এই জরাগ্রস্ত বৃদ্ধকে প্রাণান্ত পরিশ্রমের ভেতর যেতে হয়?
একটা টেলিফোন নাম্বারই আতাহারের মুখস্থ। সাজ্জাদদের টেলিফোন। সেই টেলিফোনের সমস্যা হচ্ছে–টেলিফোন ধরে নীতু। সামনাসামনি সে কথা বলে না। বললেই হয়, কিন্তু টেলিফোন সহজে ছাড়তে চায় না।
হ্যালো, নীতু?
সাজ্জাদ আছে?
না।
কোথায় গেছে?
কোথায় গেছে সেটা আতাহার ভাই আপনি খুব ভাল করেই জানেন। কিন্তু আমাদের জানাচ্ছেন না।
আমি জানি না নীতু।
আপনার এইসব রসিকতা ভাল লাগে না। সাত দিন হয়ে গেল একটা মানুষের খোঁজ নেই।
সাতদিন হয়ে গেছে?
আজ অষ্টম দিন।
আতাহার ভাই, ফাজলামি করবেন না। ফাজলামি আমার ভাল লাগে না।
ফাজলামি করছি না। সিরিয়াসলি বলছি–থানায় একটা ডায়েরি করিয়ে রাখা দরকার।
আতাহার ভাই, আপনি কি দয়া করে একটু বাসায় আসবেন? বাবা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আসব কি করে? বৃষ্টি কেমন নেমেছে দেখছিস না?
বৃষ্টি থামলে আসুন।
বৃষ্টি চট করে থামবে না। রাত দশটার দিকে বৃষ্টি থামার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।
গোঁৎ গোঁৎ শব্দে করে হঠাৎ লাইন কেটে গেল। আতাহার টেলিফোন নামিয়ে রাখতেই ভদ্রলোক বললেন, বৃষ্টি থামার সম্ভাবনা ক্ষীণ নয়, বৃষ্টি থামবেই।
ও আচ্ছা, আপনি কি পুরোপুরি নিশ্চিত যে বৃষ্টি থামবেই?
জ্বি। আবহাওয়ার ব্যাপারে আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল।
কি বই পড়ছেন এত মন দিয়ে?
বই পড়ছি না। তাকিয়ে আছি।
ও আচ্ছা।
ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, কাজেই কিছু করার নেই। দিনের পর দিন বই মুখের সামনে ধরে ধরে অভ্যাস হয়ে গেছে।
ব্যবসাপাতি ভাল না?
কোন কালেই ভাল ছিল না।
ও আচ্ছা।
সৎ ব্যবসা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। সব জিনিসের দাম আমার এখানে সস্তা। লোকে ভাবে নকল জিনিস দিচ্ছি। বেশি দাম দিয়ে জিনিস কেনা মানুষের অভ্যাস হয়ে গেছে। একই কমলা আপনি যদি দুটা ঝুড়িতে রাখেন–এক ঝুড়ির কুড়ি টাকা হালি, অন্য ঝুড়ির পঁচিশ টাকা হালি বিক্রি করেন, লোকজন পঁচিশ টাকা হালির কমলা কিনবে। আপনি নিজেও কিনবেন।
আতাহার গম্ভীর মুখে বলল, এর একটা কারণও আছে। বাংলায় একটা বাগধারা আছে–সস্তার তিন অবস্থা। এই ভেবেই সস্তার জিনিস কেউ কেনে না। নতুন একটা বাগধারা যদি রচনা করা যায়…
কি রকম বাগধারা?
চট করে বলা যাবে না। চিন্তাভাবনা করে বলতে হবে। আমি চিন্তাভাবনা করে বের করে আপনাকে বলে যাব। আপনার নাম কি ভাই?
আবদুল্লাহ। নিন, কার্ডটা রেখে দিন। যদি কখনো আপনার বা আপনার কোন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের লোহালক্করের কিছু দরকার হয়, বলবেন। বাজারের কারেন্ট প্রাইসের চেয়ে দশ পার্সেন্ট কম না হলে কান কেটে কুত্তাকে দিয়ে খাইয়ে দেব।
আমি তাহলে উঠি আবদুল্লাহ সাহেব?
অসুবিধা হবে না। আমি আগের জন্মে ব্যাঙ ছিলাম। ব্যাঙ। স্বভাবের কিছুটা এখনো আছে। বৃষ্টিতে কিছু হয় না।
ছাতা আছে। ছাতা নিয়ে যান। পরে ফেরত দিলেই হবে।
আপনার লাগবে না?
আমি দোকানের উপরের ঘরে থাকি।
বের-টের তো হবেন। ঘরে তো আর বসে থাকবেন না।
আমি বের হই না। আমার পা নেই। দুটা পা ট্রেনে কাটা পড়েছে।
সে কি?
আতাহার এতক্ষণে লক্ষ্য করল, ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন, তার গায়ের উপর খয়েরি রঙের একটা চাদর। আতাহারের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার এখন আর এক মুহুর্তের জন্যেও এই ঘরে থাকতে ইচ্ছা করছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। সে ঘোর বর্ষণের মধ্যে ছাতা হতে বের হয়ে গেল।
বৃষ্টির এতই তোড় যে ছাতায় বৃষ্টি মানছে না। ছাতার কাপড়টাও পুরানো। কয়েক জায়গায় ফুটো। ফুটো গলে মাথায় টপ টপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। আবদুল্লাহ সাহেবের বুড়ো কৰ্মচারী এই ছাতাও হাতছাড়া করতে চায়নি। ছাতা হাতে দেয়ার সময় কঠিন চোখে তাকাচ্ছিল। বুড়োকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলতে হবে।
এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ ছিলেন নিজ মনে
আপন ভুবনে।
জরার কারণে তিনি পুরোপুরি বৃক্ষ এক।
বাতাসে বৃক্ষের পাতা কাঁপে
তাঁর কাপে হাতের আঙ্গুল।
বৃদ্ধের সহযাত্রী জবুথবু-–
পা নেই, শুধু পায়ের স্মৃতি পড়ে আছে।
জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ ভাবে চাদরের রঙটা নীল হলে ভাল ছিল।
স্মৃতির রঙ সব সময় নীল।
রশীদ সাহেব ভেতরের বারান্দায় উবু হয়ে বসে আছেন। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে, তিনি বৃষ্টি দেখছেন। ঘটনা তা না–বৃষ্টির পানি জমে বারান্দা পর্যন্ত চলে এসেছে। আরো যদি বাড়ে তাহলে বারান্দা উপচে নোংরা পানি ঘরে ঢুকে যাবে। রশীদ সাহেব সেই ভয়াবহ সময়ের অপেক্ষা করছেন। গত বৎসর এ রকম নোংরা পানি ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। পানি পরদিনই নেমে গেল। দুৰ্গন্ধ নামল না। বিকট গন্ধ তিন মাস থাকল। এই ব্যাপার দ্বিতীয়বার ঘটতে দেয়া যায় না। কি করা যায় তিনি তাই ভাবছেন।
আতাহারকে ঢুকতে দেখে তিনি আনন্দিত হলেন। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ এক করা যায় না। শক্তসমর্থ সঙ্গিী-সাথী লাগে। যুবা-পুরুষ লাগে। রক্ষা পেয়েছে–কিন্তু শরীর পুরোটা ভেজা। শীতে গা কাঁপছে। গরম এক কাপ চা খেয়ে চাদরের ভেতর ঢুকে পড়ে বর্ষ যাপন করতে হবে। বাবার হাত থেকে কতক্ষণে মুক্তি পাওয়া যাবে কে জানে! বাবার তোকানোর ভঙ্গি আতাহারের ভাল লাগছে না।