আপনি ছন্দের উপর একটা বই লিখুন গনি ভাই। এই বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশি দুই বাংলায় কেউ জানে না।
গনি সাহেব আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে অতিরিক্ত গভীর হয়ে গেলেন। আতাহার মনে মনে হাসল। খাটাসটা ফ্লাটারি ধরতে পারে না। আতাহারের কথা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। খাটাসটার দোষ নেই–বুদ্ধিমানরাই ফ্রােটারি ধরতে পারে না, আর এ হচ্ছে গাধার বাচ্চা খাটাস।
আতাহার।
জ্বি।
ছন্দের উপর একটা বই লেখার ইচ্ছা আমার আছে। লিখব কাদের জন্যে? পণ্ডশ্ৰম।
পণ্ডশ্রম হলেও আপনাকেই লিখতে হবে। আমরা আপনার ছন্দজ্ঞান নিয়ে প্রায়ই কথা বলি। আপনাকে আমরা আড়ালে কি ডাকি জানেন গনি ভাই? আড়ালে ডাকি–চালুনি।
আপনাকে আমরা বলি ছন্দের চালুনি। যত বড় কবিই হোক চালুনির মধ্যে আটকা পড়ে যাবে।
গনি সাহেব অত্যন্ত প্রীত হলেন। আনন্দ তাঁর চোখ-মুখে ফুটে উঠল। উদার গলায় বললেন–তুমি ইদানীং কিছু লিখেছ না-কি?
একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলাম।
নাম কি?
বাসর।
বাসর নামে মডার্ন একজন কবি কবিতা লিখবে ভাবাই যায় না, বাসর-ফাসর হচ্ছে মিডল ক্লাস ফ্যান্টাসি।
একটু যদি পড়ে দেখেন গনি ভাই। আপনি কবিতাটা পড়েছেন এটাই আমার জন্যে বিরাট ঘটনা।
গনি সাহেব চোখ-মুখ কুঁচকে কবিতা পড়তে শুরু করলেন–এক হাতে তাল দিয়ে ছন্দ দেখছেন। ছন্দের সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয়। মাঝে মধ্যে গনি সাহেবের মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছেন।
কেমন হয়েছে। গনি ভাই?
আছে–থোর বড়ি খাড়া। খাড়া বড়ি থোর।
আতাহার মনে মনে বলল–থোর বড়ি তোর পশ্চাদেশ দিয়ে ঢুকিয়ে দেব শালা চালবাজ।
গনি ভাই।
হুঁ।
ঠিকঠাক করে যদি আপনার পত্রিকায়।
আচ্ছা, দেখি।
আপনার হাত দিয়ে একটা কবিতা ছাপা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।
দেখি দেখি–অনেক কাটাকুটি লাগবে।
আমি তাহলে উঠি গনি ভাই।
উঠবে! আচ্ছা যাও— ও ভাল কথা, এন্টাসিডের একটা বোতল এনে দাও তো–গ্রাক্সো কোম্পানীর। দাঁড়াও টাকা এনে দি।
টাকা লাগবে না। গনি ভাই আছে আমার কাছে, পরে দিয়ে দেবেন।
আবদুল গনি অত্যন্ত উদার ভঙ্গিতে বললেন, দেখি সামনের সংখ্যায় দিয়ে দেব। তবে লিসন টু মাই অনেস্ট এডভাইজ। এইসব আজেবাজে লেখা ছেড়ে ভাল কিছু লেখার চেষ্টা করো। গ্রো আপ। গ্রো আপ।
আতাহার মনে মনে বলল, হে খাটাস, তোকে আমি পুঁতে ফেলব। পাঁচ হাত গভীর একটা গর্ত করে তার ভেতর পুঁতব। গোবর সার দেব, পানি দেব, যাতে একটা গাছ হিসেবে তুই আবার পৃথিবীতে আসতে পারিস। সেই গাছে কোন ফল হবে না, ফুল ফুটবে না। সেই গাছে শুধু আঁটি জন্মাবে। শক্ত শক্ত আঁটি।
কিছু ভাবছো না-কি আতাহার?
জ্বি না।
গ্ল্যাক্সো কোম্পানীর এন্টাসিড কিনে গনি সাহেবের হাতে দিয়ে ফেরার পথে দুর্ঘটনা ঘটল। ম্যানহোলে পা বেজে গিয়ে চামড়া ছিলে গেল। ম্যানহোলের বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধানতার জন্যই ঘটনাটা ঘটেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটলে এই সমস্যা হত না। আতাহার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঘন কালো। মেঘ। আর মেঘা জমছে। মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার হয়ে এল। সুন্দর যে সব কথা সবই বলা হয়ে গেছে। সবচে বেশি বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের জন্ম বাংলা সাহিত্যের বড় দূর্ঘটনার একটি। তাঁর কারণে সুন্দরের চিন্তা ও ব্যাখ্যায় অন্যেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এই ব্যাপারটা কি কেউ লক্ষ্য করেছে?
বৃষ্টি ধরে গিয়েছিল, রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতেই আবার শুরু হল। আতাহার লোহালক্করের এক দোকানে ঢুকে গেল। নাট-বল্ট, স্ক্রুর বিশাল দোকান। দোকানের মালিক মধ্যবয়স্ক চশমা পরা এক ভদ্রলোক। গভীর আগ্রহে তিনি হাদিসের কি একটা বই পড়ছেন এবং পা নাচাচ্ছেন। লোহালক্করের দোকানের মালিক বলেই বোধহয় ভদ্রলোকের মুখ লৌহ-কঠিন। চোখ দুটিও মনে হয় পাথরের–কোন জ্যোতি নেই। ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকাতেই আতাহার বলল, বৃষ্টির জন্যে ঢুকেছি। বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।
ভদ্রলোক বললেন, কোন অসুবিধা নেই–যতক্ষণ ইচ্ছা বসুন। আতাহার বসল। ভদ্রলোক আতাহারকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, চা খাবেন? আতাহার বলল, জ্বি খাব। ভদ্রলোক পিছন ফিরে বললেন, দু কাপ চা।
এই দোকান ঘরটা লম্পবাটে। পেছন দিকে অনেকখানি খালি জায়গা। সেখানে কঙ্কালসার এক বৃদ্ধ চা বানাচ্ছে। সে এতই বৃদ্ধ যে তার মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে।
ভদ্রলোক বই পড়তে পড়তেই বললেন, বৃষ্টি আজ রাত দশটার আগে থামবে না।
আতাহার বলল, ও আচ্ছা।
একথা বলায় মনে করবেন না যে, আপনাকে বৃষ্টির মধ্যে বের করে দিতে চাচ্ছি। চা খান, যতক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করে থাকুন।
থ্যাঙ্ক য়্যু।
ভদ্রলোকের কথাবার্তা লোহা-লক্করের দোকানের মালিকের মত না। কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপকের মত। সুবর্ণ পত্রিকার মালিক হলে ভদ্রলোককে বেশি মানাত।
বুড়ে চা নিয়ে এগুচ্ছে। তার হাত এমনভাবে কাঁপছে যেন এক্ষুণি হাত থেকে কাপ মাটিতে পড়ে যাবে। বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকাই এক ধরনের টেনশন।
ভদ্রলোক বই পড়তে পড়তেই চা খাচ্ছেন। একবারও চায়ের কাপের দিকে তাকাচ্ছেন না। ভদ্রলোক বই যে পড়ছেন তাও মনে হচ্ছে না। তিনি বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন না। তার দৃষ্টি একটা পাতাতেই স্থির হয়ে আছে। বুড়ো চা ভাল বানিয়েছে। কড়া লিকার, চা পাতার সতেজ গন্ধ, দুধ-চিনি সব ঠিকঠাক আছে।
একজন মানুষের মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকা যায় না। বৃষ্টি যেভাবে নেমেছে, বের হবার প্রশ্নই ওঠে না। ভদ্রলোকের কথা ঠিক হলে এই বৃষ্টি রাত দশটার আগে থামবে না। সংসারে কিছু লোক আছে যারা ভবিষ্যদ্বাণী করতে ভালবাসে। এও বুঝি সেই পদের।