—জানি না।
—কিরণ তো সেই থেকে একটি রাতও ঘুমোয় না। আর তোকে নিয়েও ভাবে। এখন তোর কিছু হলে….
—মরে গেলে মরে যাব। কত লোকই তো মরছে।
—এখন একটু বসতে পারি, কিরণ ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়। পুরো সুস্থ না হলে রোগী দেখাও তো সম্ভব নয়। দু মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। তুই একটা চাকরি-বাকরি…
—পরের গোলামি আমি করব না।
—সংসারটা আসলে.আমাদের সেই জমিদারিও তো আর নেই। গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরুর স্বাদ আমরা পেয়েছি। তোদের কালে আর কী দেখেছিস; গ্রামের জমিজমা বিক্রি করে ফেলেছিলাম, সেগুলো থাকলেও তো শেষ বয়সে গ্রামে গিয়ে শনের একটি ঘর তুলে বাকি জীবন পার করা যেত।
সুরঞ্জন ধমকে ওঠে–বোকার মত কথা বলছি কেন? গ্রামে গিয়েই বা তুমি বাঁচতে পারতে নাকি? মাতব্বরের লেঠেলরা তোমার মাথায় লাঠি মেরে সব কেড়ে নিত না!
–সবাইকে এত অবিশ্বাস করছিস কেন? দেশে কি দু-একটা ভাল লোকও নেই?
–না নেই।
—তুই অযথা হতাশায় ভুগছিস।
— অযথা নয়।
—তোর বন্ধুবান্ধব? এতকাল যে কম্যুনিজমের ওপর লেখাপড়া করলি, আন্দোলন করলি, যাদের সঙ্গে চললি ফিরলি, ওরা কেউ ভালমানুষ নয়?
—না কেউ নয়। সবাই কম্যুনাল।
—আমার মনে হয় তুইও কিছু কম্যুনাল হয়ে যাচ্ছিস?
–হ্যাঁ হচ্ছি। এই দেশ আমাকে কম্যুনাল করছে। আমার দোষ নেই।
—এই দেশ তোকে কম্যুনাল করছে? সুধাময়ের কণ্ঠে অবিশ্বাস ভর করে।
–হ্যাঁ দেশ করছে। সুরঞ্জন দেশ শব্দটির ওপর জোর দেয়। সুধাময় চুপ হয়ে যান। সুরঞ্জন ঘরের ভাঙা জিনিসগুলো দেখে। ভাঙা কাচ এখনও মেঝোয় ছড়ানো। পায়ে বেঁধে না এসব? পায়ে না বিঁধলেও মনে তো বেঁধে!
১২খ.
সারাদিন ঘরেই শুয়ে থাকে সুরঞ্জন। তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কারও সঙ্গে কথা বা যে সময় কাটাবে, সে ইচ্ছেও নেই। একবার কি যাবে লোহার পুলে, একবার তাকাবে নীচের দিকে, মায়ার গলে যাওয়া ফুলে ওঠা শরীরটি দেখতে? না, সে আজ কোথাও যাবে না।
দুপুর পার হলে সুরঞ্জন বাড়ির পাকা উঠোনটিতে হাঁটে। একা এক উদাস হাঁটে। একসময় ঘরে গিয়ে ঘরের বই সব উঠোনে ফেলে। কিরণময়ী ঘরে বসে ভাবেন ও বোধ হয় বই রোদে দিচ্ছে, পোকায় কাটা বই। দাস ক্যাপিটাল, লেনিন রচনাবলি, এঙ্গেলস মার্কস-এর রচনা, মরগ্যান, গোর্কি, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, জ্যাঁ পল সার্ত্র, পাভলভ, রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নেহরু, আজাদ…সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাসের থানইট সাইজ বইগুলোর পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে উঠোনে ছড়ায় সুরঞ্জন, জড়ো করে, তারপর ম্যাচের একটি কাঠি জ্বেলে ওতে ফেলে। হিন্দু পেলে উগ্র মুসলমান মৌলবাদী যেমন জ্বলে ওঠে, কাগজ পেলে আগুনও তেমনই দাউ দাউ জ্বলে ওঠে। কালো ধোঁয়ায় ভরে যায় উঠেন। পোড়া গন্ধ পেয়ে দৌড়ে আসেন কিরণময়ী। সুরঞ্জন হোসে বলে—আগুন তাপাবে? এস।
–কিণময়ী অস্ফুট কণ্ঠে বলেন—তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?
–হ্যাঁ মা। অনেকদিন ভালমানুষ ছিলাম তো। এবার পাগল হচ্ছি। পাগল না হলে মনে শান্তি পাওয়া যায় না।
কিণময়ী দরজায় দাঁড়িয়ে সুরঞ্জনের যজ্ঞধূম দেখেন। তিনি যে কলতলা থেকে বালতি করে জল এনে আগুনে ফেলবেন, এই বোধও তাঁর লোপ পায়। কালো ধোঁয়ার আড়ালে সুরঞ্জনের শরীর ঢেকে যায়। কিরণময়ীর মনে হয়, সুরঞ্জন আসলে বই নয়, নিজেকে পোড়াচ্ছে।
সুধাময় ভাবেন প্রখর মেধার প্রাণবান ছেলেটি যে নিজেই বিষহরা মন্ত্রের কাজ করত, সে এখন পান করছে বিষ, বিষ পান করে করে ও নীল হয়ে যাচ্ছে, তার নিঃশব্দে শুয়ে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে চেঁচিয়ে কথা বলা, রাতে মেয়ে নিয়ে ঘরে ঢোকা, মুসলমানদের গালাগাল করা, বই পোড়ানো…সুধাময় বোঝেন সুরঞ্জন আসলে অভিমান করেছে খুব। সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র সকল কিছুর ওপর তীব্র অভিমান করে ও নিজেকে পোড়াচ্ছে হীনমন্যতার অন্ধ আগুনে।
সুরঞ্জনের বেশ আনন্দ হয় আগুন দেখতে। দেশ জুড়ে হিন্দুর বাড়িঘর এমন আগুনেই পুড়েছে। এমন লেলিহান আগুনে। কেবল কি বাড়িঘর আর মন্দিরই পুড়েছে, মানুষের মন পোড়েনি? সুধাময়ের আদর্শ ধুয়ে সুরঞ্জন আর জল খাবে না। সুধাময় বামপন্থী মানুষ, সুরঞ্জনও গড়ে উঠেছিল একই বিশ্বাসে। এসব এখন আর বিশ্বাস করে না সে। সে অনেক বামপন্থীকেও তাকে গাল দিতে দেখেছে ‘শালা মালউন’ বলে। ‘মালাউন’ শব্দটি সে স্কুল থেকে শুনে আসছে। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক লাগলেই ওরা দু-এক কথার পরই বলত ‘মালাউনের বাচ্চা’। সুরঞ্জনের চোখ জ্বালা করে জল জমে উঠে সে বুঝে পায় না। এই জল কি কোনও কষ্ট থেকে এল, নাকি আদর্শ পোড়া ধোঁয়া থেকে! পোড়া শেষ হলে সুরঞ্জন স্বস্তির শ্বাস ফেলে। শুয়ে থেকে থেকে এই বইগুলোর ওপর এ ক’দিনে যখনই তার চোখ পড়েছে, বইগুলো থেকে নানারকম নীতিকথার কীট তাকে কুরে খেয়েছে। সে আর নীতি-ফীতি মানে না। কষে একটি লাথি লাগাতে পারত যদি এতকালের বিশ্বাসের ওপর। কেন সে ধারণ করবে এসব, জ্ঞানের পেয়ালা মানুষ ঠোঁট পর্যন্ত ঠেকায়, অন্তরে নেয় না। অন্তরে একা নেবে কেন সে?
যজ্ঞ শেষে লম্বা একটি ঘুম দিতে চায় সে। ঘুম আসে না। রত্নাকে মনে পড়ে। অনেকদিন দেখা হয় না। কেমন আছে মেয়েটি। রত্নার গভীর কালো চোখদুটো পড়া যায়, ওর আর কথা বলবার প্রয়োজন হয় না। ও নিশ্চয়ই ভাবছে হঠাৎ একদিন ওর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়বে সুরঞ্জন, চায়ের সঙ্গে জীবনের গল্পগুলো পেতে বসলে রাত পার হয়ে যাবে। সুরঞ্জন ভাবে আজ রাতে সে যাবে রত্নার বাড়িতে। বলবে—কেবল কি আমিই দেখতে আসব? আর কারও কি ইচ্ছে করে না কাউকে দেখতে যাবার?