–মরব। আমি শান্ত কণ্ঠে বলি।
আমি মরব এই খবরটি শুনে আলতাফ পুলকিত হয়। আমি আলতাফের সঙ্গে মরবার জন্য মরব, ব্যাপারটি যে মোটেও সেরকম নয় তা আমি বোঝাতে পারি না তাকে। সে ভেবেই নেয় তাকে আমি ভালবাসি। সাভারের সবুজ বৃক্ষ রাজি আমার ভেতরে অদ্ভুত এক ভাল লাগা জন্ম দেয়। আমি এই প্রকৃতির সন্তান। এই সবুজ অরণ্যে বাস করা বোধহয় অনেক সুখের। গুলশানের বাড়ি ফেলে যদি এই অরণ্য বাসে যাই এরকম যখন ভাবছি আলতাফ বলে–সাভারে আমার জমি আছে জানো তো? এখানে একটা বাগান বাড়ি করব। আমরা বুড়ো বয়সে এখানে থাকব, কেমন? আমার নিভৃত বনবাসের ভাবনায় আলতাফের এই সংসার চিন্তা আমাকে গোপনে আহত করে। অরণ্যে কি ইটের দালান তুলে থাকতে হয়?
সারাপথ আলতাফই কথা বলে, আমি কেবল সবুজ দেখি। দু’চোখ ভরে সবুজ দেখি।
রাতে ‘জয়ে’ খাই। খেতে খেতে আলতাফ বলে–তুমি কি কখনও আমাকে ছেড়ে যাবে হীরা?
–হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
–মাঝে মাঝে ভয় হয়।
আমি হেসে বলি-ভয় হবার কারণটা বল তো?
–তুমি যেন ঠিক আগের মত ব্যবহার কর না।
–আগে মানে?
–বিয়ের পর পর। বিয়ের দিন তো তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোলে। এখন কি ঘুমোও বল?
–দিন কি সবসময় একরকম থাকে?
–কেন, থাকে না কেন?
–মানুষ বড় হয়। বুদ্ধি বাড়ে। দিন বদলেছে, আমিও বদলেছি।
আমি বদলে গেছি এই খবরটি শুনে আলতাফ আর কোনও প্রশ্ন করে না।
এছাড়া আমার আর কী বলবার আছে। আমার যদি তাকে জড়িয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে না করে আমি করব কী! নিজের ইচ্ছের সঙ্গে কতদিন প্রতারণা করা যায়।
সাভার থেকে ফিরে দুজনে যখন শুই বিছানায় গা হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে বলি–আমি যদি ব্লু ফিল্ম দেখতে চাই?
–ব্লু ফিল্ম দেখবে?
–হ্যাঁ। আমার কণ্ঠ কাঁপে সামান্যও, ভয়ে কিংবা দ্বিধায়।
–ব্লু ফিল্ম দেখতে চাও? এসব শেখালো কে তোমাকে? ছি ছি তুমি যে এত নিচে নেমে গেছ আমার জানা ছিল না। আলতাফের ঠোঁট বেঁকে ওঠে ঘৃণায়।
–স্বামী স্ত্রী ব্ল দেখবে, অসুবিধে কী? আমি হেসে বলি।
-বাজে কথা বলো না। আলতাফ রীতিমত ধমক লাগায় আমাকে। প্যান্ট খুলে সে লুঙ্গি পরে। লুঙ্গির ওপর দিয়ে উরুসন্ধি চুলকোয়। ঘরে ওর মুজো খুলবার দুর্গন্ধ ছড়ানো! শাশুড়ির ঘর থেকে হিন্দি ছবির শব্দ ভেসে আসে। আলতাফ চেঁচিয়ে ওঠে বু ফিল্মের কথা তুমি শুনলে কোথায়?
–আশ্চর্য, ব্লু না দেখি নামটা পর্যন্ত শুনব না এ তুমি ভাবলে কী করে? তুমি কি ভাব আমি আকাশ থেকে পড়েছি? কিছুই বুঝি না, জানি না কিছুই!
সে চোখ নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করে–ব্লু দেখতে চাও, আমার মনে হয় বু তুমি আগেও দেখেছ।
বলি–দেখিনি, কিন্তু দেখার খুব ইচ্ছে।
–আর নাম নেবে না এসবের, আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। আলতাফ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
সে হঠাৎ এক টানে তার শরীরের কাছে আমাকে নিয়ে যায়। আমি ছাড়িয়ে নিতে চাই। নিজেকে। বলি–তুমি কিছু করো না কিন্তু।
–কী করব না?
–চুমু দেবে না। কাপড় খুলবে না।
–তুমি কি কোনও প্রেম ট্রেম করেছ বিয়ের আগে? আলতাফের চোখের তারায় পেণ্ডুলামের মত সন্দেহ দোলে।
–না।
–মিথ্যে বলছ। আলতাফের লোমহীন বুকে শিশির কণার মত জমে ওঠে ঘাম।
–আমি মিথ্যে বলি না।
আলতাফ সঁড়াশির মত আমার দুবাহু চেপে ধরে। বলে–নিশ্চয়ই তোমার তার কথা মনে পড়ছে।
–কার কথা?
–কার আবার?তোমার প্রেমিকের।
লোকে ঠা ঠা করে যেভাবে হাসে সেরকম হেসেই আমি বলি–মোটেও না।
–যদি তোমার বাবা মার কাছে বলে দিই এসব?
–মিথ্যে বলবে কেন?
–আমি বুঝি সব।
–বুঝলে এসব বলতে না।
–আমাকে তুমি সহ্য করতে পারো না। কেন পারো না? আমি স্মার্ট নই? গুছিয়ে কথা বলতে পারি না? ম্যানার জানিনা? তোমাকে শাড়ি কাপড় গয়না গাটি কিনে দিই না? তোমাকে অবহেলা করি, বল?
–মোটেও না।
–তবে?
তবের উত্তর আলতাফকে আমি দিইনা। দিতে ইচ্ছেও করে না। প্রথম প্রথম মনে হত সব বোধহয় একদিন ঠিক হয়ে যাবে, আর আমার অস্থির লাগবে না। আমরা দু’জন এক সঙ্গে ঘুমোতে পারব। একজন জাগবে, একজন ঘুমোবে–এমন হবে না। কিন্তু দিন যায়, বছর পার হয়, যা ছিল তাই থেকে যায়। ঠিক এরকমই। এক বিছানায় প্রতি রাতে আলতাফের শরীর ঘেসে আমাকে শুতে হয়। না শুলে চিৎকার করে বাড়ি ‘মাথায় তোলে। শরীর তাকে সঁপে না দিলে চলবে না। আমি কিছু পাই ৰা না পাই তার তো পেতেই হবে। তার ক্ষুধার্ত থাকলে চলবে কেন? আলতাফ কোনও ত্যাগে বিশ্বাসী নয়! তার সবটুকু খাওয়া চাই, আর কারও খাওয়া হোক না হোক। তার সবটুকু পাওয়া চাই, আর কারও পাওয়া হোক বা না হোক। আমি আলতাফকে ঠিক বুঝতে পারি না। তাকে যত বারই এ বিষয়ে বলা হয়, সে বলে তোমারই দোষ।
আমি যতবারই চমকে উঠি আমার আবার দোষ কোথায়। আলতাফ বলে–তুমি কোঅপারেট কর না বলেই এমন হয়।
–আমি কোঅপারেট করি না?
–না।
–কি বলছ তুমি? আর কী করে কোঅপারেট করা যায়? তুমি যা বল তাই তো আমি শুনি। সেদিন উপুড় হতে বললে, তাই হয়েছি।
–হয়েছ। কিন্তু মন থাকে অন্যদিকে। অন্য কিছু ভাব তুমি।
আমি হঠাৎ চুপ হয়ে যাই। আসলে কী আমি অন্য কিছু ভাবি। আমি তো এরকম ভাবি আমার খুব পেতে ইচ্ছে করছে আলতাফকে, আমি তাকে সবটুকু পেতে চাই। পেতে চাইলেই কী হয়? আমার কেবল আশায় বসতি।
সে শুতে আসে। আমার নীরবতাকে বেশ উপভোগ করে আলতাফ, আমি বুঝি। আমাকে দোষ দিয়ে সে মনে মনে একধরণের তৃপ্তি লাভ করে। সে যে ভুল বলছে, মিথ্যে বলছে–তা সে মনে মনে বুঝলেও আমার কাছে স্বীকার করে না। ব্লু ফিল্ম খারাপ মেয়েরা দেখে, যারা দেখে তারা বিকৃত মানসিকতার মেয়ে, তাদের মত আমি যেন কখনও না হই কারণ আমি ভদ্র ঘরের মেয়ে, আমার পারভারশানে যাওয়া উচিত নয় ইত্যাদি বলতে থাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আলতাফের কথাগুলো আমার ঘুমের নেপথ্য সঙ্গীতের কাজ করে।
০৫. এক দুপুরে আলতাফের বন্ধু
এক দুপুরে আলতাফের বন্ধু মনজুরের স্ত্রী রুবিনা আসে আমার কাছে। গল্প করতে। কাছেই বাড়ি। কাজ নেই। স্বামী দুবাই গেছে। অবসর কাটে না। আমার সঙ্গে অবসর কাটাতে এসেছে।