–রাগ? রাগ আমি করব কেন? সে তো তুমি করেছ। আমার সঙ্গে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছ।
–এসবের কারণ তো তুমিই।
–তাই নাকি?
আমার কণ্ঠে শ্লেষ টের পাই। শ্লেষ আলতাফের কণ্ঠেও, বলে–গান গাইছ মনের কথা কইতে নাকি ইচ্ছে করছে। কার সঙ্গে তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে শুনি? সখী না সখা? একেবারে না খেয়ে লেগেছ মনে হচ্ছে?
আলতাফের কথার উত্তর আমার দিতে ইচ্ছে করে না। চোখ বুজে শুনি শুধু। আলতাফ হাসি খুশি থাকলে আমার সমাদর হয় এই বাড়িতে, সে বিষণ্ণ হলেই আমি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বস্তু হয়ে যাই। এ কেমন নিয়ম?–খাচ্ছো না কেন? আলতাফ হঠাৎ প্রশ্ন করে।
–খিদে নেই বলে।
–খিদে হবে কেন? সারাদিন বসে থাকলে খিদে হয়?
–কী করব বল? লেখাপড়া করতে ইচ্ছে করে। তাতে তো সময় কাটত।
–সময় কাটাবার কিছু পাচ্ছো না তুমি, আশ্চর্য! বাড়িতে কাজ করতে চাইলে কাজ কী কম আছে? ছোট ছোট কাজগুলো তো করতে পারো। আমি তো বলছি না তুমি কাপড় চোপড় ধোও, ঘরদোর মোছ।
–তার মানে তুমি দয়া করে হালকা কাজগুলো করতে বলছ, যেখানে বড় কাজগুলোই আমার করা উচিত ছিল।
–যা বোঝ তাই।
আমি উত্তরে আর কথা বলি না। কী আর বলবার আছে। তার সঙ্গে তো আমার বিয়েতে এরকম শর্ত হয়নি যে আমি তার বাড়ির কোনও কাজে হাত দেব না। বরং স্বামীকে সেবা করবার একটি কথা আকারে ইঙ্গিতে বাড়ির সকলে আমাকে বলেছে।
রাত বাড়তে থাকে। আমার ভাল না লাগা গুলোওে বাড়তে থাকে। বিছানায় শুতে যে যাব সে ইচ্ছে করে না। আলতাফ ঘুমোয় না, তার না ঘুমোবার কারণ বুঝি, চাইছে আমি শুতে যাই, সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ুক আমার ওপর। ভাবতেই গা রি রি করে ওঠে। নিজেকে মাঝে মধ্যে এরকমও বোঝাই যে যতই হোক, স্বামী যখন, স্বামী যা চায় তা
পূরণ করাবার দায়িত্ব তো আমারই। আমাকে তো তার ইচ্ছের কাছে মেলে দিতেই হবে আমার শরীর, এমন কি মনও। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ইজিচেয়ারটিতে, জানালার বাইরে থেকে আবার হাসনুহেনার ঘ্রাণ আসে। ঘ্রাণটি আমাকে বড় উতলা করে। একটি স্পর্শ আমার তন্দ্রা বা নিদ্রা যা হোক না কেন, ভাঙায়। চেনা স্পর্শ। বড় চেনা তার আলিঙ্গন, তার আদর আহ্লাদ। আমি সেই পর্শের ঘ্রাণ নিই, যেমন নিই হাসনুহেনার তীব্র সুগন্ধ। এই পৰ্শটি বড় আদরে আমাকে বিছানায় নিয়ে যায়। শুইয়ে দেয়। ধীরে ধীরে আলতো হাতে নিদ্রালু কাপড়গুলো সরিয়ে দেয়। তারপর, আমি যদি নদী হই, কে যেন আমার শরীরে সঁতরাতে চায়। প্রাণপণ সঁতরাতে চায়। নিঃশ্বাস ঘন এবং দ্রুত হয় তার। সে কখনও সাঁতার জানত বলে মনে হয় না আমার। সে যে এত চেষ্টা করে সঁতরাতে! আমি বলি তুমি এভাবে সঁতরাও এভাবে পা নেড়ে, ওরকম হাত নেড়ে, সে সবই করতে চায়, পারে না। দ্রুত যখন বাস পড়ে তার, একবার মায়া হয় যে বেচারা চাইছে অথচ পারছে না আর একবার রাগও ধরে যে সে পারবে না আর আমার জল ঘোলা করবে, আমি তা মানব কেন? কতরাত পর্যন্ত যে সাঁতরাবার চেষ্টা করে আলতাফ জানি না। বিরক্ত হতে চাই না কিন্তু শরীরই বিরক্ত হয়। আমার শরীরই তার সাঁতার না জানা শরীরকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সরিয়ে যে দিই তাতে কিছু বলবার থাকে না আলতাফের। সে করুণ চোখে তাকায় আমার দিকে। জ্যোৎস্নায় তার চোখের তারা দূরের নক্ষত্রের মত জ্বলে। সকালে উঠে আলতাফ আমার দিকে তাকায় না। যেন খুব ব্যস্ত সে, এত ব্যস্ত যে তাকাবার সময় পর্যন্ত নেই। আমি হেসে বলি–আজ যে এত দৌড়োচ্ছ, টিফিনও মনে হচ্ছে নেবে না।
–পূর্বাণীতে লাঞ্চ করে নেব।
–এত টাকা তোমার, সরকারি চাকরিই বা কর কেন?
–ও তুমি বুঝবে না।
–ও।
আলতাফ কথাগুলো বলে কিন্তু চোখের দিকে না তাকিয়ে। তাকাতে লজ্জা হয় নিশ্চয়। তড়িঘড়ি চলে যায় অফিসে। ওর অফিস যাওয়া দেখে আমারও ইচ্ছে করে অফিস যেতে। আমি একদিন বলেছিলাম আলতাফকে সকাল বেলা উঠে আমিও যদি অফিস যেতে পারতাম!
আলতাফ হো হো করে হেসেছিল। হাসবারই তো কথা। বাড়ির বউ, যাকে কি না ঘর সংসারে ভাল, দেখতে ভাল বলে আনা হয়েছে, সে যদি ঘর সংসার ছেড়ে চাকরি করতে চায় তবে তো হাসতেই হবে। শাশুড়ি সেদিন ভিসিআরে ছবি দেখবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। রমজানকে দিয়ে ছবি আনালেন তিনি। রূপ কি রাণী চোর কে রাজা। আমি নাম দেখে ঠোঁট উল্টে বললাম–দুর এসব বাজে। শাশুড়ি হেসে বলেন–আরে না না, দেখই না।
ছবি যখন চলছিল, শাশুড়ির হাতে ছিল তসবিহ, তিনি এনজয় করছিলেন। আমি অবাক হয়ে শাশুড়ির হাসি হাসি চোখমুখ দেখছিলাম। শাশুড়ি সারাদুপুর ছবি দেখলেন। আমি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম তার বিছানায়। রাতে ঘুম হয় না, তাই ঘুমও পায়, আর এই ধরনের ছবি আমাকে জাগিয়ে রাখবার কোনও ক্ষমতা রাখে না।
বিকেলে ফেরে আলতাফ, সকালের চেয়ে স্বাভাবিক। বলে–চল যাই আজ সাভারে যাই, নিজে গাড়ি চালাব কেমন? সাভারে ঘুরে জয় নামে রেস্তোরাঁয় খেয়ে চলে আসব কেমন?
আমি বলি–চল।
আলতাফ আমাকে খুশি করবার জন্য এই প্রস্তাব করেছে আমি বুঝি। দিন দিন আমি যেভাবে ক্ষেপে উঠছি, আমাকে খুশি না করালে তার চলবে কেন।
আমরা একসঙ্গে বাইরে যাচ্ছি দেখে শাশুড়ির মুখেও হাসি ফোটে।
গাড়ি যখন দ্রুত ছুটে চলে আমি দুদিকের নদী খাল বৃক্ষ ও মানুষ দেখি। আলতাফ কলকল করে কথা বলে। ওর বেশির ভাগ কথাই এরকম, লোকে আমাদের বলে চমৎকার জুটি। বলে প্রেম ট্রেম ছিল নাকি আগে থেকে। আলতাফ ভাল চালায় গাড়ি, তবু বলে কী ভয় পাচ্ছো না তো? ধর দুজনে যদি মরে যাই এমন একসিডেন্ট হয়?