আলতাফকে শিশুর মত স্নিগ্ধ লাগে দেখতে। ওর নিঘুম রাতের কষ্টের কথা ভেবে আমারও কষ্ট হয়। কতক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ও একটি বাক্যও আমার জন্য খরচ করে না। সকালে ওর জন্য নিজের হাতে নাস্তা করি। চা দিই। চুপচাপ সে খেয়ে ওঠে। কথা বলে না। বলি–এত রাগ?
আলতাফ তবুও কথা বলে না। জুতোর গটগট শব্দ তুলে অফিসে চলে যায়। এই যে আমি তোকে জুতোর ফিতে পর্যন্ত বেঁধে দিলাম। যাবার সময় বললাম–একটু হাসো। তারপরও হাসল না সে। গেটে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লাম, একবার ফিরে তাকাল না।
দুপুরে ফোনে সে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলল, আমার সঙ্গে বলল না। বিকেলেও ফিরল না। ফিরল রাতে। শাশুড়ির সঙ্গে ড্রইং রুমে বসে কথা বলছিলাম, রুমে ঢুকেই আলতাফ বলল–এত রাত পর্যন্ত আপনি জেগে আছেন? আলতাফের মা হেসে বললেন–তুই এত দেরি করলি বাবা?
–আর বলবেন না। এক বন্ধুর বিয়ে ছিল।
–ও।
আমি পাশে বসে মা ছেলের কথপোকথন শুনে গেলাম। এক বন্ধুর বিয়ে অথচ আমাকে সামান্য জানানোও হয় না। বিয়ে বাড়িতে যাওয়া না হয় বাদই দিলাম। তাছাড়া আমি যে একটি মানুষ বসে রইলাম। আমি যে তাদের কেউ হই, বোঝা গেল না। কোন বন্ধু, কী নাম, কার সঙ্গে বিয়ে হল, মেয়ে খুব ভাল, লেখাপড়া জানা মেয়ে, বড় ফ্যামিলি, বাবা ইঞ্জিনিয়ার, মেয়ের ভাই বোনেরা কানাডা থাকে, ইত্যাদি নিয়ে আলতাফ তার মায়ের সঙ্গে গল্প করল। তারা দুজনেই ভুলে গেল আমার উপস্থিতি। আমি নিঃশব্দে চলে এলাম ঘরে, শোবার ঘরে, এই ঘরটিই তো মূলত আমার ঘর, কারণ এখানে আমি স্বামী নিয়ে শোব। আমার তো শোওয়াই একমাত্র কাজ। আমি ঘরে বাতি নিবিয়ে শুয়ে থাকি। আলতাফ ঘরে ঢুকেই ষ্টিকবা জ্বালায়। আমার চোখে হঠাৎ বাতি এসে পড়লে রাগ ধরে বড়। বলি–লাইট বন্ধ কর।
–আমি অন্ধকারে কাপড় ছাড়ব?
–জানি না। তুমি লাইট বন্ধ কর।
আলতাফ বাতি জ্বালিয়েই সার্ট খোলে, লুঙ্গি পরে লুঙ্গিখানা সঁতে কামড়ে প্যান্ট আর আণ্ডার ওয়ার খোলে। আমি দেখি আর আমার রাগ ধরে। বাতি জ্বালিয়ে রেখেই সে বাথরুমে যায়। বাথরুমে আবার একটি গান ধরে আলতাফ। ‘এক পেয়ার ক্যা নাগমা হ্যায়…..।‘ গানের সূরটি আমার ভাল লাগে। সূরটি ভাজতে ভাজতে সে ঘরে আসে। আমি তখন চোখ বুজে শোয়া। সূরটি সে ছাড়ে না। বাতিও নেয় না। আলতাফের সূর আমার সব রাগ জল করে দেয়। আমি আলোকিত ঘরটিতে ঘুমোবার প্রস্তুতি নিই। আমি লক্ষ্য করি আলতাফ আমার সঙ্গে কথা বলছে না। আমাকে সে স্পর্শও করছে। সকাল হয়। সে অফিসে চলে যায়। আমি তার সঙ্গে ছায়ার মত ঘুরি। আমাকে সে দেখেও দেখে না। তার বাবা মার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেয়। বাড়িতে আমি যে। একটি প্রাণী সে ভুলে যায়। অথবা দেখায় সে ভুলে আছে। আসলে ভোলে না। সে যে ভোলে না সে কি আমি বুঝি না? বুঝি কিন্তু কিছু বলি না। কিন্তু কতদিন এরকম চলবে? কতদিন? রাতে পাশে শুয়ে ছটফট করে আলতাফ। ও যে দিন দিন অন্যরকম হয়ে উঠছে বুঝি। আমার কষ্ট হয়, আলতাফের জন্য মায়া হয়। একবার ইচ্ছে হয় তাকে দোষ দিই, আবার এমনও মনে হয় দোষ বোধ হয় আমারই। দোষ যারই থাক আমরা কেন উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখব? সম্পর্কটি স্বাভাবিক করবার জন্য তাগিদ আমারই থাকে বেশি। শাশুড়ি একদিন ডাকলেন তার ঘরে, বললেন–আলতাফ এমন চুপচাপ থাকে কেন বৌমা?
–জানি না।
–জানি না মানে? শাশুড়ি পাল্টা জিজ্ঞেস করেন। আমার কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি আবার বলেন–তোমাকেই তো জানতে হবে। তুমি ছাড়া আর জানবে কে!
–সে কেন চুপচাপ থাকে সে প্রশ্ন তো তাকেই করতে পারেন। আমি কি তার সব জানি? শাশুড়ি বেজায় রাগ করেন। রাগলে তিনি জোরে জোরে শ্বাস ফেলেন। ফর্সা মুখোনা লাল হয়ে ওঠে। তিনি সম্ভবত বুঝে পান না তার সুপুত্রের প্রতি আমি এই অন্যায় আচরণ কেন করছি। মোটাসোটা মহিলা, বাতের ব্যথায় প্রায়ই কাতরান, বাহুতে ঘড়ির চেইনের মত কী একটা লাগিয়েছেন কৰ্জিতেও একটি পিতলের চুড়ি। এক রাতে ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন, আমি গিয়ে হাত পা টিপে না দিয়ে বললাম–এসব কী লাগিয়েছেন, এগুলো খুলে ফেলুন। এগুলো লাগালে ব্যথা আরো বাড়ে মনে হয়।
–কি বললে? শাশুড়ি কটমট করে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন।
আমি এরকমই। যা বলতে ইচ্ছে করে বলে ফেলি। বলবার আগে সাত পাঁচ ভাবব এমন নই। শাশুড়ির মূল প্রশ্ন আলতাফের হয়েছে কী, এত প্রাণবান ছেলের এমন উদাস ভাব কেন, কেন চুপচাপ থাকে বাড়িতে। আমি মনে মনে বুঝি কেন সে কথা কম বলে, সে যে আমি তাকে আমাকে ছুঁতে বারণ করেছি বলে অভিমান করে চুপ থাকে তা কিন্তু নয়। সে অনেকটা বাঁচেও বৈকি। আমাকে অস্থিরতা দান করা থেকে এ তো একরকম বাঁচাই।
আলতাফ কিন্তু বেশিদিন গাম্ভীর্য ধারণ করতে পারে না। আমাকে সে ছোয়, ছুঁতে তাকে হয়ই। আমি তার নিশপিশ আঙুল দেখে বুঝি সে একটি সোমখ নারী শরীরের জন্য কি ভীষণ কাতরাচ্ছে। বসেছিলাম, শোবার ইচ্ছে করছিল না সেদিন। গুণগুণ গান করছিলাম আমার ইচ্ছা করে তোদের মত মনের কথা কই, ওলো সই। আলতাফ বোধহয় মন দিয়ে শুনছিল, সে বসেইছিল এই আশায় যে আমি তাকে খেতে ডাকব, যেমন ডেকে নিই শ্বশুর শাশুড়িকে, আমার সেদিন কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করছিল না। কেবল গান গাইতে ইচ্ছে করছিল। খেতে কোনও ইচ্ছে নেই। খোলা জানালা পথে এক আকাশ পূর্ণিমা হুড়মুড় করে ঢুকছে ঘরে, আমার মুখে এসে পড়ছে তার আলো, তার অবাধ আলো। খেতে আমার না ইচ্ছে করতেই পারে। আমারই যে সবাইকে ভাল লাগাবার দায়িত্ব থাকতে হবে, তা কেন! আলতাফ একাই খেয়ে আসে। আমাকে ডাকে না। ডাকে না বলে আমার যে খুব কষ্ট হয়, তা নয় কিন্তু। আমি যেমন বসেছিলাম তেমনই থাকি। পূর্ণিমায় একা একাই স্নান করি। খেয়ে এসে আলতাফ শোয় বিছানায়। শুয়ে বেডসুইচ অন করে। এক ঘর জ্যোৎস্নার মধ্যে দজ্জালের মত আচমকা উপস্থিত হয় এক থোকা বিদ্যৎ। আমি অলস বসে থাকি ইজিচেয়ারে। আলতাফই হঠাৎ প্রশ্ন করে–খাওয়া টাওয়াও বাদ দিয়েছ নাকি? এত রাগ?