ওর রাগের কারণ আমি বুঝি। কিন্তু আমার ইচ্ছে না করলে কী করব আমি। আমার ভেতরে সে আগুন কেবল জ্বালিয়ে দেবে, নেভাবে না–এ কী করে মেনে নেব? নেভাবার নিয়ম তো আমার জানা নেই, জানা থাকলে হয়ত নিজেই কিছু চেষ্টা করতাম। আমি উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ি। আলতাফের কথার কোনও উত্তর দিই না।
–কী ব্যাপার কথা বলছ না যে!
–বলতে ইচ্ছে করছে না।
ওর গলা যত উঁচু, আমার গলা তত খাদে। আমি বিছানার এক কিনারে আলতাফের শরীরে যেন আমার শরীর না লাগে এমন আলগোছে শুয়ে থাকি।
–তোমার হয়েছে কী বল তো? আলতাফ ভারি গলায় জিজ্ঞেস করে।
–কিছুনা।
–কিছু না বললেই হবে? তোমার কিছু একটা হয়েছে। তুমি আমাকে লুকোচ্ছ। আমাকে কিন্তু অবহেলা করছ তুমি।
–বোধ হয় করছিই।
–আমি সারাদিন কার জন্য পরিশ্রম করি বল, এই সংসারের জন্য, তোমার জন্য। তোমার জন্য, আর বাড়ি ফিরে যদি তোমার বিশ্ন মুখ দেখতে হয়, ভাল লাগে? কি এত দুঃখ তোমার?
এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। লজ্জা হয়, সংকোচ হয়। কেন মন বিষণ্ণ থাকে, বুঝি, দুঃখ কেন, বুঝি; কিন্তু বোঝাতে পারি না। আলতাফ অভিমান করে, রাগ করে। এপাশ-ওপাশ করে। আমার স্থির শান্ত শরীরের দিকে তৃষ্ণার্ত চোখে তাকায়। আমি নিজেকে সংবরণ করি। জলের লোভে লোভে সমুদ্রের কাছে যাব আর সে আমাকে সমুদ্রের উতল নোনা জোয়ারে একলা রেখে চলে যাবে, আমি সাঁতার জানি না, ভাসব ডুবব, আমার কষ্ট হবে, ভীষণ কষ্ট হবে আমার–এই ভেবেই আমি। সংবরণ করি। তৃষ্ণা গুলো সংযত করি।
আমি ধীরে খুব শান্ত কণ্ঠে বলি–কাল থেকে আমি অন্য ঘরে ঘুমোব।
–কেন?
–আমার ইচ্ছে।
এক বিছানায় ঘুমোলে আমি টের পাই আলতাফের নিশ্বাসের হলকা আমার গায়ে লাগছে, আমার গা গরম হচ্ছে। গা কেন গরম হয়? না হলেও তো পারে। না হলে চমৎকার যুবকটিকে আমি আরও বেশি ভালবাসতে পারতাম। আরও বেশি তার কাছে আসতে পারতাম, শরীরের না হোক, মনের কাছে।
মনের কাছে আসতে গেলে কোনও বাধা তো থাকা উচিত নয়। মনই তো সব থেকে বড়। মনের কাছে শরীর বড় তুচ্ছ। তবু আমি জানি না কেন আমি বলি–আমার ইচ্ছে হয় না তোমার সঙ্গে ঘুমোতে। আমার প্রব্লেম হয়।
আলতাফ চুপ হয়ে থাকে।
ওর জন্য মায়াও হয় আমার। মায়া হয় বলে যদি আমি ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে যাই, আমাকে সে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে। অন্ধকারে একটি ভালবাসার স্পর্শ ধীরে ধীরে শিথিল করবে আমার শরীর। আলতাফকে আমি ভালবাসতে চাই, কিন্তু এসবের জন্যই পারি না। এই জড়িয়ে ধরা এই চুমু খাওয়া এসব আজকাল বড় বিব্রত করে আমাকে। বড় অবিন্যস্ত করে।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে আলতাফ আমার গা ধাক্কা দিয়ে বলে–তুমি খুব বাড়াবাড়ি করছ, হীরা।
–কিরকম বাড়বাড়ি? ওর ধাক্কায় মোটেও না চমকে বলি।
–খুব সেক্স ক্রেজি হয়ে উঠছ।
–তাই নাকি? যদি তা-ই হই অসুবিধে কী?
–অল্পে তোমার মন ভরছে না। তোমার অনেক বেশি চাই।
–সে তো তোমার চাই। আমি তো চাইছি না কিছুই। আমি দিব্যি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে থাকতে চাই। তুমি আমাকে ডিসটার্ব না করলেই পারো।
–আমি তোমাকে ছুঁলে তুমি ডিসটার্ব ফিল কর?
–হ্যাঁ করি।
–বলছ কী তুমি? আলতাফ তড়াক করে উঠে বসে। বলে–তুমি আমাকে অপমান করছ হীরা।
–হ্যাঁ করছি।
আলতাফের বাস পড়ে জোরে। সে আমার শরীর ধরে আবার ঝাঁকুনি দেয়। বলে–তুমি কি ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার স্বামী?
–না মোটেও না। ভুলব কেন? বরং খুব বেশি করেই মনে থাকে।
–তাহলে আমাকে তোমার সহ্য হবে না কেন? আমি কি তোমার পর?
–স্বামী হলেই বুঝি আপন হওয়া যায়?
আলতাফ বিছানায় বসা ছিল, দাঁড়িয়ে যায়। উঠে পায়চারি করে ঘরময়। ফোঁস ফোঁস শব্দ হয় ওর রাগের। বলে-তবে কে তোমার আপন শুনি? কোন আপন মানুষ তুমি ফেলে এসেছ? আমাকে তুমি পর ভাবছ, আমি তোমার স্বামী আর আমিই তোমার পর?
আমি পাশ ফিরে মাথার বালিশটি বুকে জাপটে ধরি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি–আমাকে ঘুমোতে দাও। এত রাতে তোমার এসব বোকা বোকা কথা আমার ভাল লাগছে না। আলতাফ বাথরুমে যায়। মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। টেনশন হলে সে এরকমই করে আমি ঘুমোতে চাই। আলতাফ পারলে সারারাত জেগে থাকুক। আমার কী যায় আসে! আমি যখন জেগে থাকি ও কি আমার খবর নেয়?
আলতাফ সারাঘর হাঁটে আর বলে–তুমি কি চাও বল তো? কী দিলে তোমার তৃপ্তি হবে। তোমার জন্য আমি সব করব। বল, মুখ ফুটে বল কি চাও।
–তুমি ভাল করেই জানো আমি কী চাই।
–কাল মার্কেটে চল। যা ইচ্ছে হয় কেননা। তবু তুমি আমার সঙ্গে এসব করো না।
–মার্কেট থেকে কী আনতে চাও আমার জন্য? সুখ পাওয়া যায়? পাওয়া যায় সুখ তোমাদের নিউমার্কেটে? গাউছিয়ায়? গুলশানে? মৌচাকে? পাওয়া যায়?
আমার ভেতরে লাভার উদগীরণ দেখি। আলতাফ চুপ হয়ে যায়। চুপ না থেকে ও করবে কী। ওর কী আর করবার আছে? ওকে আমি দোষ দিই না কিন্তু ও আমাকে অস্থির করে মারবে কেন? আমার কি পাওয়ার কিছু নেই? আমার কি শূন্যতাকেই একমাত্র গন্তব্য বলে ধরে নিতে হবে? রাত বাড়তে থাকে। আলতাফ একবার বিছানায় শোয়, একবার ওঠে, সে গজরাতে থাকে রাগে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি আলতাফ ঘরের ইজিচেয়ারে বসা। চোখ জানালার দিকে। জানালাটির ওপারে একসারি দেবদারু। দেবদারুরও রূপ আছে। কী চমৎকার সুঠাম বৃক্ষ। আমি বিছানা থেকে না উঠেই রাতের শিশির ধোয়া বৃক্ষের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। আলতাফ কি সারারাত ঘুমোয়নি? আমি উঠে দাঁড়াই ওর চেয়ারের পেছনে। হাত রাখি চুলে। চুলগুলো কী সুন্দর! ঘন। ছেলেদেরও এত ঘুন চুল হয়! আমি আঙুল বুলিয়ে দিই ওর চুলে। আলতাফ আমার স্পর্শ বোঝে। রিয়েক্ট করে না। যেমন ছিল তেমন বসে থাকে। আমি ওর চুলে হাত বুলোই আর বলি–তুমি আমার ওপর রাগ করো না। রাত হলে আমি অন্য রকম হয়ে যাই। রাত হলে কী যে হয় আমার! আমার।