প্রব্লেম কি তবে এই ঘুম না আসাই! আলতাফের ঘুমের শব্দ শুনি আর আমার অস্থিরতা বাড়ে। ইচ্ছে হয় ওর মত আরাম করে ঘুমোতে, ওর মত তৃপ্তি নিয়ে। ওর মত কোনওদিকে না ফিরে। কে ঘুমোল কে ঘুমোল না এ নিয়ে যেমন ওর ভাববার সময় নেই, আমারও যদি সময় না হত। আমি যদি নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার কপালে চুমু খায় আলতাফ। আমার তখন এত ভাল লাগে যে রাতে খামোকা ঘুম না হওয়ার জন্য নিজের ওপরই রাগ হয়। উঠে ওর জন্য পরাটা মাংস করা, জামা জুতো এগিয়ে দেওয়া, দরজায় দাঁড়িয়ে ওর অফিসে চলে যাওয়া দেখতে বড় ভাল লাগে আমার। গোপনে সুদর্শন যুবকটির জন্য অদ্ভুত এক ভালবাসা জন্মায়।
আলতাফ আমাকে প্রায় বুঝিয়ে ফেলে যে–এরকমই হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরকম ঘটনাই ঘটে। তবে আমার যে অস্থিরতা, এগুলো হচ্ছে আমার দোষ। দোষ কাটাতে চাই, অস্থিরতা কমাতেও। অস্থিরতা তো আর কমে না, লুকিয়ে ঘুমের ওষুধ খাই। অফিসে খাটাখাটনি বেশি হলে আলতাফ যেদিন সকাল সকাল শুয়ে পড়ে, সেদিন আমি লক্ষ্য করেছি আমার কোনও যন্ত্রণা হয় না। আমি দিব্যি ঘুমিয়ে পড়ি। আসলে ও চুমু টুমু না খেলে, কাপড় জামা খুলে সারা শরীরে উষ্ণ হাত না বুলোলে আমার ভেতরে যে খুব গোপনে একটি সমুদ্র জাগে, সেটি জাগে না। আর না জাগলে আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে না।
এরকম চলে দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত। এরকম অস্পষ্ট, অপুষ্ট একটি সম্পর্ক আমাকে সরিয়ে দেয় অন্ধকারে বাড়ানো আলতাফের হাত, ঠোঁট। আমি সেদিন বলেছি–আমার ভাল লাগছে না। শরীরে হাত দিও না শুধু শুধু।
–মানে? আলতাফ চমকে ওঠে আমার আচরণে।
–আমি ঘুমাব। পাশ ফিরে শান্ত কণ্ঠে বলি।
–আরেকটু পরে ঘুমোও। একসঙ্গে ঘুমোব দুজন। আলতাফ তার দিকে আমাকে টেনে নিয়ে বলে।
–না তুমি জানোও না তুমি যে একা ঘুমোও আমার ঘুম হয় না। বিরক্ত লাগে।
–বল কী? … তোমার সমস্যাটা ঘুচল না তা হলে!
–সমস্যা আমার না কি তোমার আগে ভেবে দেখ।
আমি লক্ষ্য করে অবাক হই আমার কণ্ঠে আগের সেই বিনয় নেই। একটু যেন রূঢ় শোনায় কথাগুলো।
আলতাফ বলে–তোমার শরীরে হাত দিতে না করছ আমাকে?
যেন অসম্ভব একটি কথা আমি বলেছি এমন তার গলার স্বর।
-হ্যাঁ করছি। আমি পাশ ফিরে চোখ বুজে উত্তর দিই। এসব কথাবার্তার চেয়ে আমার যে ঘুমিয়ে পড়া জরুরি তা বোঝাতে চাই। আলতাফ মানে না। জিজ্ঞেস করে-কেন?
–জানি না।
–তোমাকে জানতে হবে। আঁঝাল কণ্ঠস্বর আলতাফের।
আমি চুপ করে থাকি। আর আলতাফ হেঁচকা টানে খুলতে থাকে আমার শাড়ি। আমি এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলি–এসব আমার ভাল লাগে না।
–আমি তোমার স্বামী, মাইণ্ড ইট। এসব ভাল লাগতেই হবে। আলতাফের কণ্ঠস্বর কঠিন শোনায়।
আমি অস্বীকার করছি না সে আমার স্বামী। তাকে আমার ভাল লাগে একথাও সত্যি, যখন সে অফিসের জন্য কাপড় চোপড় পরে, নাস্তার টেবিলে বসে, যখন হাত নেড়ে হেসে চলে যায় দেখতে ভাল লাগে। ব্যস। যখন ফিরে আসে, গল্প করে, হাসে–ভাল লাগে কিন্তু ভাল লাগে না আমার শরীরখানায় আঙুল ছোঁয়ালেই, শরীরে হাত দিলে শরীর আমার অস্থির হয়, অস্থিরতা কেন ভাল লাগবে আমার? নিজের শরীরকে প্রবোধ দেব এত ক্ষমতা আমার নেই। এত ক্ষমতা আমি অর্জন করিনি। যদি ঘুমিয়ে থাকি, আমি তো আর বলছি না ঘুমের মধ্যে আমি এই চাই সেই চাই; কিন্তু যদি জাগাও আমাকে, জাগলে আমার নানা কিছু চাই, আমি স্নান করব খাব বেড়াব খেলব। যদি নানা কিছুর ব্যবস্থা না করতে পারো, তবে দয়া করে আমাকে জাগিও না।
০৪. তুমি ছুঁয়ো না আমাকে
প্রতি রাতে যতই আমি আলতাফকে বলি যে তুমি ছুঁয়ো না আমাকে, সে ছোঁবেই। সে ছুঁতে চাইবেই, না ছুঁলে তার স্বস্তি নেই। ছুঁলে আমার অস্থিরতা, না ছুঁলে তার অস্থিরতা। ভীষণ এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। যখন ও শোবার জন্য বিছানায় যায়, আমি ড্রইং রুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে বই বা ম্যাগাজিন পড়ি। শুতে না যাবার ছুতো করি। আলতাফ অনেকক্ষণ বিছানায় অপেক্ষা করে ড্রইং রুমে আসে।
–’কী তুমি শুতে যাবে না?’ ওর পরনে একটি কেবল লুঙ্গি থাকে। ওর খালি গা দেখলে আমার কেমন ঘেন্না ধরে। বলেছি কত ঘুমোবার সময় ট্রাউজার পড়, আর টি শার্ট না হোক স্যাণ্ডা গেঞ্জি হলেও পড়। তা না, আলতাফের লুঙ্গি না হলে চলবে না। আর থাকতে হবে খালি গায়ে। বুকে হাত বুলাবে আর আমাকে আড়চোখে দেখবে। দূর থেকে একগাদা মাংস দেখে কুকুর যেমন জিভ চাটে, আলতাফও মনে মনে বোধহয় নিজের লালা নিজে গিলে খায়। সেও বোধহয় তার লোভের লাল জিভখানা বারবারই চাটে।
আমি বিরক্ত হই আলতাফের ডাকাডাকিতে। বলি–আমি এখনই শোব না। ঘুম পাচ্ছে না।
–বিছানায় এস, ঘুম পাবে।
আলতাফ দাঁত বের করে হাসে। যেন বিছানায় আজ খুব মজার জিনিস আছে, ঘুম না পেয়ে যায়ই না।
–তুমি শোও। আমি পরে আসব। আমি বই থেকে মুখ না তুলেই বলি।
আলতাফ চলে যায় বেডরুমে। আমি তার ঘুমিয়ে যাবার অপেক্ষা করি। ঘুমিয়ে গেলে বিড়ালের মত নিঃশব্দে হেঁটে শুতে যাব। যেন সে না জাগতে পারে, জেগে যেন সে আমাকে সারারাত জাগিয়ে না রাখতে পারে। রাত প্রায় দুটো বাজলে আমি শুতে যাই। আলতাফ না ঘুমিয়ে শুয়ে ছিল। আমাকে দেখেই বলে–এখন আর শুতে এলে কেন? রাত তো শেষ করেই এলে।