আলতাফ বলে–না। না। শরীর খারাপ হবে কেন?
–সারাদিন একা ঘরে শুয়ে থাকে। বলি ভিসিআর দেখ। গান টান ভাল লাগলে শোন। কিছুই করে না।
-–ও কিছু না। বাড়ির কথা মনে পড়ে তো, তাই।
–তাই বা হবে কেন? ইস্কাটন গিয়েও নাকি ওই অবস্থা করে।
–ঠিক হয়ে যাবে। এত ভেব না তো এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে।
শাশুড়ির বয়স হয়েছে। সারাদিন ঘরে বসে তাসকেরাতুল আউলিয়া, বেহেসতি জেওর আর মোকসেদুল মোমেনিন পড়েন। পঁচবেলা নামাজ পড়েন আর আখেরাতের জন্য জীবন গুছিয়ে রাখেন। অবশ্য জগৎ সংসারের দিকে তার যে মনোযোগ একেবারেই নেই তা ঠিক নয়। তিনি প্রায়ই আমেরিকা যান। বড় ছেলের কাছে মাস ছয় থেকে আবার ফেরত আসেন। এখনও শক্ত সমর্থ বেশ। সকালে পার্কে হাঁটেন। বিকেলে নিয়ম করে ফলের রস খান। স্বাস্থ্য ভাল, চোখেও ভাল দেখেন। হাতে তসবিহ নিয়ে হাঁটেন আর বিড়বিড় করেন–’ঠিকের তো কিছু দেখছি না। পাশের বাড়ির মেয়েরা এসেছিল সেদিন। ভাবী ভাবী বলে কত ডাকল। বউ তো কোনও বা শব্দ করল না। ঘরের দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি ওদের বললাম বউমার শরীর খারাপ, আরেকদিন এস।’
আলতাফ শোনে, কিছু বলে না। আমি বুঝতে পারি না আমার কী করা উচিত। আমি কি এখন আগের মত হাসব? আগের মত, বিয়ের আগে যেমন রিনিঝিনি হাসতাম, কথা বলতাম! কিন্তু জোর করে কি হয় এসব! আলতাফ আমার মন ভাল রাখবার জন্য তার বন্ধু বান্ধবের বাড়ি নিয়ে যায়। সোহেল, রকিব, লতিফ, মনজুরের বাড়ি। সবার এক কথা–’ভাবী আমাদের সঙ্গে এত কম কথা বললে চলবে না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে আপনার। কী, আলতাফ বুঝি ঘুমোতে দেয় না আপনাকে? হা হা হা।‘ ওরা হাসে সবাই, আমার দিকে চোখ ছোট করে তাকায়।
মনে মনে বলি ও কেন ঘুমোতে দেবে না! ও তো আমাকে ঘুমোতেই দেয়, আমারই ঘুম আসে না। আলতাফ বন্ধুদের সঙ্গে রহস্যের হাসি হাসে। যেন ও সত্যিই আমাকে ঘুমোতে দেয় না। ও আমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখে। সারারাত আমাকে আদর করে ও যেন ওর আদর পেয়ে আমি ভরে আছি শরীরে, মনে। আমি যেন তৃপ্ত, তুষ্ট এক নারী। আমার কোনও কষ্ট নেই। কোনও অভিযোগ নেই কারও প্রতি।
আলতাফের বন্ধুরা, বন্ধুর স্ত্রীরা আমাকে নিয়ে পড়ে; নতুন বিয়ে হয়েছে বলেই বোধ হয় অথবা আলতাফকে তাদের বিশেষ পছন্দ আর আমার চেহারাছবিও তাদের মনপুত হয়েছে। আমি কী খেতে পছন্দ করি, কী গান ভাল লাগে আমার, কী পোশাক পরতে ভাল লাগে সব তাদের জানা চাই। আমার চোখের নিচের কালির অন্য অর্থ হয়। আমি বা আলতাফ কেউ সংশোধন করে দিই না যে সারারাত আদরে মেতে উঠবার জন্য নয় চোখের নিচে আমার জেগে থাকবার দাগ। এ অন্য দাগ। এ আমার কষ্ট পোহানো দাগ। এ আমার দুঃখ রাতের গান। সারারাত আমি আলতাফের ঘুমন্ত, তৃপ্ত শরীরটিকে ছুঁয়ে নিঘুম রাত পার করি। আমি তাকে আমার আরও গভীর গহনে চাই। কেবল চাই ই। পেতে পারি না। কত কত রাত আলতাফকে ডেকে তুলে বলেছি–তুমি একা একা কী করে ঘুমোও! আমার যে ঘুম হচ্ছে না!
আলতাফ বলেছে–’আমি কী করতে পারি বল। তুমি ঘুমোবার চেষ্টা কর। ঘুম এসে যাবে। আমার তো সকালে অফিস যেতে হবে। তোমার মত না ঘুমোলে তো আমার চলবে না।‘
আলতাফ ঘুমিয়ে পড়ে। আমার ঘুমোবার কোনও আয়োজন না করেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার বলতে লজ্জা হয় কেন আমার ঘুম আসে না। আলতাফ নিশ্চয়ই বুঝতে পারে কিন্তু সে এমন ভান করে সে কিছুই বোঝে না আমার ইনসোমনিয়ার ব্যাপারটি। সে কিছুই বোঝে না এ আমার বিশ্বাস হয় না–সবই বোঝে সে। সবই বোঝে উত্থানরহিত সুদর্শন পুরুষটি। আমার সামনে তার যত অবুঝ অবোধ ভঙ্গি।
আলতাফ তার বন্ধুদের কাছ থেকেও ক্রেডিট নেয়। সে খুব ভাল প্লেয়ার এই জাতীয় ক্রেডিট। আমি ম্লান হাসি। ফাঁস করি না কিছু। স্বামীর দুর্বলতা ফঁস করব এমন অকৃতজ্ঞ স্ত্রী নই আমি। সতীসাধ্বী স্ত্রীলোককে মানায় না এব। পতিব্রতা হলে সমাজে মান থাকে। আলতাফ এবং তার বন্ধুরাও ভাল বলে। আমি যদি চিরকাল এমন মুখ বুজে পড়ে থাকি, লোকে বলবে এমন ভাল মেয়েই হয় না। এমন লক্ষ্মী বউ খুব কমই দেখেছি। এসব কথার দাম আছে মেয়েদের জীবনে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি মেয়েদের কী আছে! মা প্রায়ই বলেন—’এই ফ্যামিলিতে মেয়ে নিয়ে কোনও স্ক্যাণ্ডাল হয়নি। দেখিস স্বামীর সঙ্গে কখনও যেন কোনও গণ্ডগোল না হয়।‘ মাও বোঝাতে চান, স্বামীর সঙ্গে কিছু হলে স্ক্যাণ্ডাল আমার হবে, স্বামীর নয়।
০৩. সারারাত কী করে আলতাফ
সারারাত কী করে আলতাফ আমার সঙ্গে? কিছু কি করে? কিছু তো করে না, করবার চেষ্টা করে শুধু। বিয়ের পর পর আমি অনেকদিন তার চেষ্টায় সাহায্য করেছি। সে বলেছে–এরকমই হয়। সব ছেলেদেরই হয়।
–কিন্তু আমার এমন লাগে কেন? আমার প্রশ্নে এক তাল সরলতা থক্থক্ করে।
-–কি লাগে? আলতাফ জিজ্ঞেস করে।
–এমন অস্থির অস্থির?
–ও তোমার প্রব্লেম।
–আমার প্রব্লেম?
–হ্যাঁ।
আলতাফ যখন বলে এটা আমার প্রব্লেম, আমি বুঝে পাই না প্রব্লেম কী করে আমার হয়। বড় লজ্জা হয়। অপরাধবোধও কাজ করে আমার মধ্যে। কিছুতে মন বসে না কোনও কাজে। রাতে ও যখন বাতি নিভিয়ে শুতে আসে; আমার, আমি লক্ষ্য করি দ্রুত বাস পড়ছে। অপরাধবোধ থেকে একধরনের সিটিয়ে থাকা ব্যাপার ঘটে আমার মধ্যে। আলতাফ শুয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে–’বউ আমার বউ সোনা, আমার হীরে, হীরের টুকরো বউ।‘ বলে বলে আমার ঠোঁটে ও গাঢ় করে চুমু খায়। যখন চুমু খায়, আমি বুঝে পাই না আমার এমন লাগে কেন। কোথায় যেন, কেমন যেন ভাল লাগে। যখন বলে–’হীরে আমার, গায়ে এটা কী পড়েছ, খুলে ফেল তো। আমার খুলতে হয় না, ও নিজেই খুলে দেয়। খুলেই বহুদিনের না খাওয়া ভিখিরি সামনে গরম ভাত পেলে যেমন গোগ্রাসে খায়, তেমন আমাকে, আমার সর্বাঙ্গ ও খায়। আমার সারা শরীর শিরশির করে। লজ্জা ভয় অপরাধবোধ টোধ কিছুই থাকে না। কোথায় যেন, কেমন যেন বড় ভাল লাগে আমার। আমি ওকে দু হাতে জড়িয়ে ধরি। ও যখন আমার স্তনজোড়ায় মুখ ঘসে, আমি নিজেই অবাক হই অবচেতনে আমার কণ্ঠের ‘আহ আহ শব্দ শুনে। আমার এত কেন ভাল লাগে! আলতাফও গোঙায় খুব, গোঙাতে গোঙাতে আমার সারা শরীরে ও হাত বুলোয়, চুমু খায়। আমি বুঝি, আমার কোথায় যেন জলের স্রোত নামছে, আমি ঘেমে উঠছি, ভরে উঠছি। আমি ওকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরি। ও আমার শরীরের সঙ্গে মিশে যেতে চায় কিন্তু কী একটা হয় ওর, ও হঠাৎ, আমি কিছু বুঝে উঠবার আগে, আমার গায়ের ওপর নেতিয়ে পড়ে। আমার তখনও দ্রুত বাস পড়ছে। তখনও আমার শরীরের ভেতর ভীষণ এক সমুদ্র গর্জে উঠছে। আলতাফ পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। আর আমি ছটফট করি। এপাশ ওপাশ করি। আমার অস্থির লাগে। আলতাফ নাক ডাকে। আমার প্রব্লেম কোথায়, খুঁজে বেড়াই। খুঁজে পাই না। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় এই যে অস্থির লাগে এটিই বোধহয় প্রব্লেম। আমার তো শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। আমার যে ঘুম আসে না!