কায়সার বলে–উঁহু, এই চমৎকার দিনে তোমাকে ছাড়া ভালই লাগবে না, চল ভিজি।
ভেজার কথা উঠতেই আমার মন নেচে ওঠে। বলি–চল।
দু’জনে রাস্তার তাবৎ লোকের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে মহসিন হলের কাছে এলে কায়সার বলে–রুমে গিয়ে চল সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মেখে খাই।
অমি বলি–সঙ্গে চা, কেমন?
কায়সার হেসে বলে–নিশ্চয়ই। পারলে ভুনা খিচুড়ি বেঁধে খাব।
আমার ভাল লাগে খুব। কায়সারের সঙ্গে আমার ইচ্ছেগুলো অনেকটা মিলে যায়। ও আবার ভাল গান গাইতে জানে। চা খেতে খেতে ওর গান শোনা গেলে মন্দ হয় না। একটি সিঙ্গল খাট, টেবিল বোঝাই এলোমেলো বইপত্র। মশারিটি ঝুলে আছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কায়সারের রুমটি। সে একটি তোয়ালে হাতে দিয়ে বলে–মাথাটা মুছে নাও। ঠাণ্ডা লাগবে।
তোয়ালে হাতে নিয়ে বলি–চা খাওয়াও আর গান শোনাও।
কায়সার হিটারে কেটলি চাপায় আর ভরাট গলায় গায় ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে, বাহির হয়ে এসো’ ….
টেবিলের কোণা ঘেসে দাঁড়িয়ে দু একটি বই এর পাতা উল্টাই। আর কায়সারের চা বানাবার আয়োজন দেখি। তার ঘরে আসবার আহবান সে এত গভীর করে করে যে তার গানের লয় তাল হয়ত শুদ্ধ হয় না, কিন্তু গানে আমি প্রাণ খুঁজে পাই। দু’কাপ চা হাতে নিয়ে এসে সে বলে–কী এখনও মাথাটা মুছলে না, জ্বর হলে বুঝবে।
আমি বলি–হোক, আমার খুব জ্বর হোক। তুমি আমাকে দেখতে যাবে। আমার কপাল ছুঁয়ে জ্বর দেখবে। কাছে বসবে, বলবে ভাল হয়ে যাও। শুনে আমার খুব ভাল লাগবে। হোক না, খুব জ্বর হোক আমার।
আমার কণ্ঠে কী ছিল জানি না কায়সার মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। পলক না ফেলা চোখ। আমারও জ্বরের ঘোর কাটে যখন আমার হাতদুটো ধরে সে বিছানায় বসায়। ওর শরীর ভেজা। বুকের সঙ্গে লেগে সপসপ করছে ভেজা শার্ট। ও আমার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে আমার মাথা মুছিয়ে দেয়। মাথা থেকে মুখ, মুখ থেকে বুক, আমার সমস্ত শরীর ও তোয়ালে দিয়ে মোছে। আমার ভেজা শরীরে ওর উষ্ণ হাতের স্পর্শ এসে লাগে। আমি চোখ বুজে ওর উষ্ণতাটুকু উপভোগ করি। বারবার কেঁপে উঠি। ও আমার ঠোঁটে গাঢ় চুমু খায়। আমি আর নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে রাখতে পারি না। ছড়িয়ে দিই। গোলাপ যেমন ফুটতে গিয়ে পাপড়িগুলো ছড়ায়, তেমন। ঘরে আর নেই কেউ। দুজন মাত্র মানুষ আমরা। শরীর জেগে ওঠে ঘামের গন্ধমাখা কায়সারের আলুথালু বিছানায়। আমি ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ওর ভেজা বুকে মুখ রেখে বুক ভরে শ্বাস নিই। নেব না কেন? আমাকে কে বাধা দেবে? ভালবাসার কাছে, নিজের গভীর গাঢ় ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবার যোগ্য আমি তো হয়েছিই। ধুম বৃষ্টির জলে ভালবাসা মিশে এমন এক সুগন্ধ আনে যে আমি সেই সুগন্ধ থেকে আর মুখ তুমি না। কায়সারের লোমশ বুক থেকে আমার মুখ তুলতে ইচ্ছে করে না। ও আমাকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে রাখে। তারপর কী হয় আমি ঠিক বুঝতে পারি না, দু’জন মানুষ ভালবাসতে বাসতে কোথায় হারিয়ে যাই। হারিয়ে যেতে যেতে বুঝি আমার পিপাসা মিটছে। পিপাসা মিটছে আমার।
আমার শরীর কতকাল কিছু যেন চেয়েছিল, খরার জীবনে জল চেয়েছিল সামান্য, আর হঠাৎ না চাইতেই অবাধ বৰ্ষণ জোটে সুখের। পিপাসা মিটছে আমার। এক শরীর পিপাসা। ঊষর জমি জুড়ে জলপতনের শব্দ, ফসলের সবুজ দোলা, আমি হারাই অন্য এক অচেনা জগতে। কী ঘটে আমার শরীরে বুঝি না, পিপাসা কেন মিটছে তাও বুঝি না, পিপাসা যখন মিটছে আমি কায়সারের পিঠ আঁকড়ে ধরি প্রচন্ড সুখে, শির্ষসুখে; ওর পিঠে আমার দশ নখের দাগ বসে যায়।