এরকম যেদিন ভাবলাম, তার পরদিন অফিস থেকে ফিরেই দেখি কায়সার আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। সে টিউশনি ঠিক করে এসেছে আমার জন্য। তিনটে টিউশনিতে টাকা পাব আড়াই হাজার! চাকরিটি ছেড়ে দেওয়া যে ভাল আমাকে বোঝাতে এসেছে সে। চাকরিটি সময় বেশি খায় বলেই ওর আপত্তি। কায়সারের সঙ্গে সেদিন হাঁটতে হাঁটতে কাটাবনের মোড় অবধি যাই, সে আমাক দু’হাত ভরে রজনীগন্ধা কিনে দেয়, এত ফুল, ফুলের এত সুবাস আমি রাখব কোথায়! মনে পড়ে কতবার আলতাফকে বলেছিলাম অফিস থেকে ফেরার পথে রজনীগন্ধা এনো। আলতাফ বলেছিল দুর ওসবে পোকা হয়। পোকা হোক, তবু তো সুগন্ধ দিচ্ছে, মৃত্যু আছে বলে আমরা কি জীবনকে গ্রহণ করি না! গ্রহণের আনন্দ আলতাফ একেবারেই বোঝে না। আলতাফ আমাকে জয় করতে চেয়েছিল ওর অগাধ বিত্ত দিয়ে, ওর সৌন্দর্য দিয়ে; পারেনি। আর কায়সার তার আহামরি রূপ ছাড়াই, বিত্ত ছাড়াই আমাকে জয় করে ফেলেছে। আমি অভিভূত হচ্ছি দিন দিন। একদিকে কায়সার, আরেক দিকে পুরো জগৎ। আমার সামনে আর সব ধুসর হয়ে যায়। আমি অনেকদিন ভাল করে চুল আঁচড়াই না, ভাল কাপড় পরি না, মনে হত কী প্রয়োজন এইসবে! জীবন তো শেষ হয়ে গেল, গ্লানিময় জীবন। অথচ আশ্চর্য–চুল এখন শ্যাম্পু করে উড়িয়ে দিই, আড়ং থেকে জামা কিনে আনি, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে যখন দেখি, কায়সারের চোখ দিয়ে দেখি। কায়সার একদিন বলে–তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। শুনে আমার লজ্জাও লাগে আবার ভালও লাগে। আমার ভাল লাগার কোনও সীমা থাকে না। দিন রাত আমি ডুবে থাকি অতল ভালবাসায়। আমি বুঝি আমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। আমি ভুলে যাচ্ছি আমি একটি রক্ষণশীল ঘরের মেয়ে। আমার একটি স্বামী আছে। এখনও আমি আইনত তার কাছে বাধা, এখনও সে ইচ্ছে করলে এক পাড়া মানুষের সামনে আমার ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। আমার শক্তি নেই বাধা দেবার। লোকে বলবে স্বামী যখন, তার তো অধিকারই আছে অবাধ্য স্ত্রীকে যেমন করেই হোক বাগে আনবার।
এর মধ্যে বাবা আসেন অফিসে। এসে আমাকে দেখে যত তাঁর অবাক হবার কথা তত হন না। আমি অনুমান করি তিনি জানেন আমি এই অফিসে কাজ করি। আমার চোখে চোখ পড়ে তার। চোখ নামিয়ে সোজা ঢুকে যান মনজু কাকার রুমে। রুম থেকে বেরিয়ে আসেন ঘণ্টাখানেক পর। এম ডির পাশের রুমেই আমি বসি, আমাকে ডিঙিয়েই তাঁকে যেতে হবে। আমি ভেবেছিলাম তিনি আমার সামনে দাঁড়াবেন এবং অড কোনও সিচুয়েশনে আমাকে পড়তে হবে। আমি প্রস্তুত ছিলাম যে কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য। তিনি যদি আমাকে উঠে যেতে বলেন, আমি যাব না। তিনি যদি আলতাফের প্রসঙ্গ টানেন, বলব আমি তাকে ডিভোর্স দিচ্ছি। তিনি যদি বলেন চাকরি করা চলবে না, আমি বলব আমি চাকরি করবই। আমি প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে আমি কী করব কী করব না সেটা আমি বুঝব। যদি বলেন বাড়িতে চলে আয়, হোস্টেলে থাকা চলবে না, সে ক্ষেত্রেও বলব যেদিন আমার ইচ্ছে করে সেদিন যাব। আমাকে জোর করলে আমি যাব না। আমাকে জোর করলে আমিও জোর করব। গায়ের শক্তি যতটা খাটানো যায়, খাটাব। যদি ভয় দেখান, কী ভয় দেখাবেন আর! এই অফিসের লোক, অফিসের বাইরের লোকেরা বাবার যুক্তি মেনে নেবেন জানি। বলবেন বাবা তো আমার ভালর জন্যই করছে। আমি মানব না। অভিভাবকরা একটি নির্দিষ্ট ছকে মেয়েদের ভাল চান। সেই ছকে নিজের জীবনকে ফেলে নিজেকে আমি অনেক অপমান করেছি। বাবার বা কোনও অভিভাবকের সাধ্য নেই বোঝেন যে এই অপমানের প্রকৃতি ঠিক কী রকম। আমি যদি বলি স্বামী আমাকে সুখ দিতে পারছে, যে সুখ আমি তাকে দিতে পারছি–তবে এমন উত্তর আসতে পারে কী দরকার পার্থিব সুখ টুখের, মেয়ে হয়ে এত সুখের আশা করা ঠিক মানায় না, অসভ্যের মত শোনায় অর্থাৎ নির্লজ্জ মেয়েরা স্বামীর সুখ ছাড়াও নিজের সুখের কথা ভাবে। আমি ভাবব না কেন? আমি নিজের সুখের জন্য উদগ্রীব হলে খারাপ দেখায় আর আলতাফ যখন উন্মাদ হয়ে ওঠে আমাকে পিষে একটু সুখ পাবে বলে কই কেউ তো তাকে খারাপ বলে না বরং আমি বাধা দিলে বলে তোমার বাধা দেওয়া উচিত নয়। কেবল স্ত্রীরই কি দায়িত্ব স্বামীকে সুখী করবার! এই নিয়ম যত বড় বিজ্ঞ ব্যক্তিরাই তৈরি করুন আমি মানতে রাজি নই। দু’জনের মধ্যে যদি ভালবাসা না থাকে তবে লোকে কী বলবে ভয়ে আমি সেই ভালবাসাহীন নরকে বাস করব–এ আমার দ্বারা কখনও সম্ভব নয়। ‘লোক’ একটা ভেগ টার্ম। লোকের ভয় দেখিয়ে মেয়েরা যা করতে চায় তা করতে দেওয়া হয় না, এতে কিছু নপুংসক, অর্থলোভী, স্বার্থপর, হিংসুক, ঈর্ষাকাতর, অবিবেচক পুরুষ আনন্দ লাভ করে। আর কিছু নয়। আমি অবাক হই বাবা আমার টেবিলের সামনে না দাঁড়িয়ে চলে যান। পরে মনজু কাকা যখন রুম থেকে বের হন, তিনিও আমাকে কিছু বলেন না কিন্তু আমি অনুমান করি আমাকে চকরি থেকে বাদ দেওয়ার আদেশ বা অনুরোধ আমার বাবা করেছেন। ইতিমধ্যে আমি কাজ শিখে গেছি। মনজু কাকা কি ডিসিশান নেবেন আমার ব্যাপারে জানি না। যে ডিসিশানই নেন, আমি যেন সবকিছুর সামনে নিজের জোর নিয়ে দাঁড়াতে পারি নিজের জন্য আমি এরকমও একটি সিদ্ধান্ত নিই।
সেদিন সারাদিন বৃষ্টি। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসে কায়সার। আমি হোস্টেলের রুমে বসে চাকরিটির কথা ভাবছিলাম। মনজু কাকা এখনও জানাননি কিছু। যা কিছুই জানান আমি ভড়কে যাব না। আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল থাকব। এরকম ভাবতে ভাবতেই কায়সারের সঙ্গে গেটে দেখা করতে যাই। তাকে বলি–আজ চলে যাও, আজ কোথাও বসে কথা বলবার জায়গা নেই।