রিক্সায় বসে কায়সার হাত রাখে আমার পিঠের পেছনে। কী রকম যেন লাগে। কী রকম এক আনন্দ। কায়সারের চোখের দিকে তাকালে কী রকম টুকরো টুকরো ভেঙে যাই ভেতরে। আমার ভেতর হঠাৎ এই ব্যাপারটি ঘটেনি। আমি অল্প অল্প করে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি আমি কী চাই, কায়সার ডাকলেই যে চলে আসি, সে কেন ডাকে, আর আমিই বা আসি কেন–এ কী দুদিনের মোহ, একসময় কেটে যাবে? উত্তর জোটে, কায়সার প্রতারণা না করলে মোহ কাটবে কেন? সে যদি সুস্থ সমর্থ পুরুষ হয়, ভালবাসা ম্লান হবে কেন? কায়সার এক বিকেলে টি এস সির মাঠে দাঁড়িয়ে বলে মনে হয় তোমাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি।
–অনেকদিন মানে কতদিন?
–জন্ম থেকে।
আমি আবার কেঁপে উঠি। টিএসসির ব্যস্ত মাঠ ছেড়ে ইচ্ছে করে দূরে কোথাও চলে যাই, সামনে কোনও নদী রেখে চুপচাপ বসে থাকি। নক্ষত্র ভরা আকাশ দেখব আর : গান গাইব—’পিপাসা হায় নাহি মিটিল।’
পিপাসা আমার তো মেটেইনি। আমার শরীর ভরে, হৃদয় ভরে প্রবল পিপাসা। কায়সার কি আমার পিপাসা মেটাতে পারবে, যদি না মেটাতে পারে, যদি সে আলতাফের মত ওরকম ছিঁড়ে খাওয়া লোক হয়! কেবল কষ্ট দেবে, সুখ দেবে না! কী করে বুঝি, পরখ করবার উপায় কী। পরখ করে দেখতে ইচ্ছে করে। কায়সারের জন্য কী রকম যেন লাগে আমার। ওকে বড় ছুঁতে ইচ্ছে করে। কতদিন কাউকে ছুঁই না। আমার আঙুলগুলো তৃজ্ঞার্ত হয়ে থাকে। কতদিন জল পায় না, কতদিন কারও পৌরুষ ছোঁয়া হয় না আমার। কতদিন কেন, আমি কবেই বা ছুঁয়েছিলাম কাকে?
আলতাফকে ছুঁতে আমার ভাল লাগত, কিন্তু ওর প্রবলেম যখন একটু একটু করে প্রকাশিত হল তখন আর ছুঁয়ে ভাল লাগেনি ওকে। মনে হত কোনও জড় কিছুকে পর্শ করছি। টেবিল চেয়ার জাতীয় কিছু। আলতাফের জন্য মাঝে মাঝে আমার মায়াই হয়। বেচারা। আবার এও ভেবে রাগ হয় ও বিয়েই বা করতে গেল. কেন, ও তো জানতোই শরীর ওর সাড়া দেয় না, ও কেন কষ্ট দেবার জন্য আমাকে এমন লোক জানিয়ে ঢোল বাজিয়ে বিয়ে করল? আমি আলতাফকে ক্ষমা করতে পারি না। সেইসব দিনের কথা ভাবলে আমার শরীর থেকে আগুন ছিটকে বেরোয়। আমি ওই নিষ্ঠুর স্বার্থপর মানুষটিকে ক্ষমা করতে পারি না।
রাতে শুয়ে থাকি একা বিছানায়। কায়সার কী আমাকে ভালবাসে? বাসেই তো মনে হয়। ও ডাকলেই আমি ছুটে যাই, আমার ভেতরেও যে ওর জন্য কিছু একটা কাজ। করে, কিছু একটা তীব্রতা তা নিশ্চয় বোঝে কায়সার। আমি কেন সামলে চলব, আমি কি কারও কাছে জীবন বন্ধক দিয়েছি যে নিজেকে সংযত করব, নিজেকে আটকে রাখব একটি অদৃশ্য খাঁচায়! কে আছে আমার যে আমি তার জন্য ভাবব, আমার মনে হবে আমি অন্যায় করছি! বরং মনে হয় আরও আগে আলতাফের ঘর আমার বেরিয়ে আসা উচিত ছিল, আরও আগেই প্রতারকটির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে আসতে পারলে অনেকটা সময় আমি নিজের জন্য পেতাম।
কায়সার যে আমাকে ভালবাসে তা আর গোপন করতে পারেনি। ও জানে আমি বিবাহিতা এক মেয়ে, এখনও সম্পর্কটি টিকে আছে আলতাফের সঙ্গে, তারপরও কায়সার কাছে আসে, তার প্রাপ্তি কতটুকু না জেনেই আসে। এই ভালবাসা শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানি না। মাঝে মধ্যে মনে হয় ওকে ফিরিয়ে দিই। কিন্তু ফিরিয়েই বা দেব কেন। আমি কি আলতাফের কাছে কখনও ফিরে যাব যে কায়সারকে প্রত্যাখান করতে হবে আমার! সে আসুক, ভালবাসুক, আমি তার ভালবসায় গা ভিজিয়ে স্নান করব! আমাকে কে বাধা দেবে, আলতাফের কী ক্ষমতা আছে আমাকে বাধা দেবার! সে বড়জোর আইন দেখাবে। তালাকনামা পাঠিয়ে দিলে কোথায় যাবে আইন! এসব ঠুনকো কাগুঁজে সম্পর্কের কোনও জোর আছে বলে আমার মনে হয় না। কাগজ দিয়ে মানুষকে আটকে রাখা যায়, যদি মন না চায়! আমি হঠাৎ হঠাৎ ভুলেই যাই আলতাফ নামের এক লোকের স্ত্রী আমি। আমি তার ঘরে দীর্ঘদিন থেকেছি। ভাবলে আমি অবাক হই একটি লোক নানারকম দোষের তলে আমাকে ফেলেছে। আর আমিও নির্বিচারে মেনে নিয়েছি তার সব মিথ্যাচার। যেটুকু প্রতিবাদ করেছি তা করা না করা সমানই ছিল। কষে যেখানে দু ঘা লাগানো দরকার সেখানে গাল ফুলিয়ে রাখলে চলে! আমি অপোস করেছিলাম বলেই আমার এই দুরবস্থা। সবাই ভেবে নিয়েছে একে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করানো যায়। এ তো মেনে নেবেই সব নির্যাতন।
১৬. মনজু কাকা বলেছেন
মনজু কাকা বলেছেন বাবা ফোন করেছেন তার অফিসে। আসবেন। আমার প্রসঙ্গে কোনও কথা হয়নি। আমি কিন্তু অনুমান করি বাবা সব জেনেই আসছেন। আমি এর মধ্যে আরও একটি জিনিস ভেবে নিই, তা হল, কাজি অফিসে গিয়ে আলতাফের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলব। ঝুলে থাকা ব্যাপারটি আমাকে হঠাৎ হঠাৎ জ্বালায়। একদিন ছুটি নেব অফিস থেকে। সারাদিনে তালাকনামার কাগজপত্র পুরণ করব আর সেলেব্রেট করব দিনটি। তালাক নামা পেয়ে আলতাফের কী রকম রাগ ধরবে ভেবে আমার বেশ আনন্দ হয়। নিশ্চয় সে রাগে ফুলে উঠবে। ফুঁসে উঠবে। হাত কামড়াবে। সারা বাড়ি দাপাবে। ওর মা বলবে মেয়ের সাহস কত, আগেই বলেছিলাম মেয়ে খারাপ, আলতাফের মা বিশ্বাস করবেন ছেলে তার সৎ সাহসী সমর্থ পুরুষ আর চরিত্রহীন হলাম আমি; তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আলতাফই একমাত্র জানে তার দোষ দুর্বলতা। সে-ই জানে তাকে ছেড়ে যাবার কী কারণ আমার। যেদিন তালাকের কাজ করব, আমি সিদ্ধান্ত নিই, দিনটি আমি উদযাপন করব। অনেকদিন পর শাড়ি পরব, সাজব। সঙ্গে সেদিন কায়সার থাকলে ওকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরে বেড়াব। দুপুরে কোথাও খাব।