অফিসে কাজ তেমন নেই। টেলিফোন রিসিভ করা, ফাঁইল পত্র গুছিয়ে রাখা, এমডির রুম থেকে সাইন করে নিয়ে আসা ইত্যাদি। এসব কোনও পরিশ্রমের কাজ নয়। ফাঁকে ফাঁকে বিএ পরীক্ষা দেবার কথা ভাবি। হোস্টেলে এত মেয়ে, অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, এ অন্য এক জগৎ, আমার একা লাগে না। হোস্টেলের অনেক মেয়েই চাকরির ফাঁকে ফাঁকে পড়ালেখা করে। আমি কিছু বই পত্র সংগ্রহ করি। এত ব্যস্ততা আমার জীবনে আর আসেনি। সকাল নটায় অফিস, পাঁচটায় ফেরা, ফিরে কখনও হোস্টেল, কখনও রোকেয়া হল, পাপড়ির বাড়িতে আড্ডা দিতে যাওয়া–সময় যে কী করে চলে যায়, বুঝি না।
সব কিছুর পর আমি যখন রাতে ঘুমোতে যাই, আমার শরীর জেগে ওঠে শুভ্র বিছানায়। আমার ইচ্ছে করে কোনও এক সক্ষম পুরুষের স্পর্শ পেতে। হোস্টেলে সুফিয়া নামে এক মেয়ে আছে, ডিভোর্সি মেয়ে। সে ফাঁক পেলেই তার অতীতের কথা পাড়ে। স্বামীটি খুব শরীর চাইত তার, এত বেশি ছিল তার কামনার আগুন, সুফিয়ার পক্ষে সম্ভব হত না তার তৃষ্ণা মেটানো। স্বামী গণিকাগমন করত, এ নিয়ে ঝগড়া, ঝগড়া বাড়তে বাড়তে ছাড়াছাড়ি। সুফিয়ার ঠিক উল্টো আমি, কামনার আগুন আমাকেই জ্বালিয়েছে। সে আগুনে পুড়ে আজ ছাই হয়েছি আমি অথবা খাঁটি সোনা।
১৫. ছেলেটির সঙ্গে
ছেলেটির সঙ্গে আগে আমার পরিচয় ছিল। মিতুল নামে আমার এক বন্ধুর চাচাতো ভাই টাই হবে। তাকে হঠাৎই একদিন দেখি হোস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। আমি প্রথম নাম মনে করতে পারিনি তার। দেখেই জিজ্ঞেস করলাম–কী ব্যাপার আপনি এখানে?
–হ্যাঁ। তুমি এখানে কেন? বলল ছেলেটি।
–আমি থাকি এখানে।
–ও তাই বল। মিতুলকে সেদিনও জিজ্ঞেস করেছি হীরা এখন থাকে কোথায়। বলল জানে না। আর আমিও অনেকদিন ভেবেছি তোমার কথা।
কথা বলতে বলতে নাম মনে হল। কায়সার। সাদামাটা চেহারা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কিন্তু চোখদুটো তাকিয়ে থাকবার মত সুন্দর। সেই চোখ থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারি না। কায়সারের সঙ্গে মিতুলের বাড়িতে দেখা হত। দুএকবার কথা হয়েছে। মনে রাখবার মত এমন কিছু নয়।
–আপনি এখানে কেন? জিজ্ঞেস করি।
–আমার বোন থাকে এই হোস্টেলে।
–আপনি কি মহসিন হলেই আছেন?
বাহ মনে রেখেছ কোন হলে থাকি? মনে মনে বলি মনে আর রেখেছিল। সবই তো ভুলে বসে আছি। নামটাও মনে পড়েনি। অল্প চেনা ছেলেকেই বড় আপন মনে হয় আমার। ছেলেটি আমাকে যে পছন্দ করত তা মিতুলও কথায় কথায় আমাকে বলেছিল। আমার সঙ্গে পরিচিত হবার আশায় সে মিতুলের জন্মদিনে গিয়েছিল। কায়সার পলটিক্যাল সায়েন্সে ফাঁইনাল ইয়ারে পড়ে। আমি গেটে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, বলল–চল হেঁটে হেঁটে কথা বলি।
কী আর কথা। মিতুলের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সেদিনের কথা মনে পড়ে মিতুলের বাড়িতে যেদিন লজ্জায় কথাই বলিনি তার সঙ্গে, তার বড় বোন ব্যাংকে চাকরি করে এইসব। আমি ছোট চাকরি করি বলাতে কায়সার অবাক হয়ে বলে–এই বয়সে চাকরি করছ? পারো চাকরি করতে? তুমি তো সেদিনের বাচ্চা মেয়ে। কায়সার হেসে ওঠে।
আমিও হেসে উঠি-আমি বোকা মেয়ে?
কায়সারের বোন গেটে এসে দাঁড়ায়। আমরা আবার দেখা হবে জাতীয় কিছু বলবার : আগেই বিচ্ছিন্ন হই। কায়সারকে এরপর প্রায়ই দেখি গেটে দাঁড়ানো। একদিন বলল–আজ তোমার জন্য এলাম।
–আমার জন্য? আমি বিস্মিত হই।
–তোমার জন্য বুঝি আসতে নেই? তোমার সঙ্গে কথা আছে। কথাটি হচ্ছে–তোমার চাকরি করা এখন উচিত নয়। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির দরখাস্ত চাওয়া হয়েছে। এপ্লাই কর।
–আমার চাকরি না করলে চলবে কেন?
–টিউশনি কর। তবু ভর্তি হও।
–আপনি এত করছেন কেন আমার জন্য? আমি তো বলিনি।
কায়সার চুপ হয়ে যায়। বলে–সরি।
সেদিন আর কথা হয় না। রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকি। সেই কবে বাড়ি থেকে মাকে ডিঙিয়ে বেরিয়ে এসেছি। জীবনে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। ওঁরা খবরও রাখেন না। নাকি আলতাফ গভীর কোনও ষড়যন্ত্র করছে। হঠাৎ একদিন তুলে নিয়ে যাবে? ভয় লাগে। একা ঘরে শিউরে উঠি আমি। মনজু কাকা বলেছেন কাজ ভাল হলে দুমাস পর বেতন বাড়াবে। মন্দ নয় চাকরিটা। আবার হলে থেকে ভার্সিটিতে পড়াশুনাও হবে-কায়সারের এই প্রস্তাবটিও মন্দ নয়।
ক্লান্ত এক বিকেলে কায়সার ডেকে পাঠায় হোস্টলের গেটে। আমার জন্য কোনও ভিজিটর অপেক্ষা করছে নিচে, ভাবতে ভাল লাগে। কায়সার ভর্তি ফরম নিয়ে এসেছে। চোখে চোখ পড়তেই হেসে বলে–তিনটে টিউশনি কর, হয়ে যাবে।
–চাকরি ছেড়ে দেব?
–চাকরি কি আর পাবে না পরে? চাকরি করলে তুমি তো ক্লাস করার সময় পাচ্ছো না।
কায়সারের কণ্ঠে ভালবাসা টের পাই। আমি ভর্তি হই না হই তার কী, অথচ যেন তার বড় একটি কর্তব্য এই ব্যাপারে আমাকে বোঝানো। কায়সার হাঁটতে হাঁটতে বলে–পল সায়েন্সে ভর্তি হলে তোমার কোনও অসুবিধে নেই। আমি তো আছিই। কায়সারের ‘আমি তো আছিই বাক্যটি আমাকে কেমন কাঁপায় ভেতরে ভেতরে। আমি হাঁটতে হাঁটতে বলি-ভালই একটি নিয়ম হয়েছে, আপনার সঙ্গে বিকেলে হেঁটে বেড়ানো।
–তোমার ভাল লাগে বেড়াতে?
বলি–খুব।
কায়সারের মুখ হাসিতে ঝলমল করে ওঠে, বলে–চল যাই, একদিন চল রিক্সা করে ঘুরে বেড়াই, ভাল লাগবে হাওয়া খেতে।
আমি মাথা নাড়ি। আমার যদি ভাল লাগে, যাব না কেন? যাব। কায়সারের ঢিলে সার্ট, না আঁচড়ানো চুল, গভীর চোখ, উদাস হাঁটাচলা সব আমার ভাল লাগে। মনে হয় বিকেলটা যদি কায়সারের সঙ্গে এমন গল্প করে কাটে, তবে মন্দ কী। আমাদের মুখে বলা হয় না, তবু বোঝা হয়ে যায়, কায়সার বিকেল হলেই আসবে, আমি তার সঙ্গে গল্প করতে রাস্তায় বেরোব। কখনও ক্রিসেন্ট লেকে গিয়ে বসব, কখনও কোনও রেস্তোরাঁয়, একদিন হাঁটতে হাঁটতে আমরা শাহবাগের একটি রেস্তোরাঁয় বসি। চা সিঙারা খাই। বিল দেয় কায়সার। আমি বলি–একদিন আমি খাওয়াব আপনাকে। আমার নিজের পয়সা, বাধা দেবার কে আছে। পরদিন বিকেলে শাহবাগ ছাড়িয়ে চলে যাই মতিঝিলের কাফে ঝিলে। পরাটা আর ঝাল ফ্রাই খাই দু’জন। আমি বিল মেটাবার পর কায়সার বলে–নেক্সট আমি খাওয়াব। কী বল?