মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ প্রবলেম। প্রবলেমই তো। বাবার বাড়ি থেকে কোনও সাহায্য করা হবে না যেহেতু আমি স্বামীর ঘর থেকে চলে এসেছি। তাই টিউশনি করতে হবে। তখন মনজু কাকা হেসে হেসেই বললেন টিউশনি করে আর কত পয়সা পাবে? আমার কোম্পানিতে চাকরি কর।
–আপনার এখানে চাকরি? কি বলছেন? আমি পারব নাকি?
–শিখিয়ে নেব। অসুবিধে কী?
অতল জলে ডুবে যাচ্ছে এমন মানুষের হাতের কাছে মাটির পাড় পেলে বোধ হয় এমন আনন্দই হয়। আমার এমনই আনন্দ হয় যে আমি অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি।
কাকাকে বলি–আপনি কিন্তু বাড়িতে বলবেন না।
–কেন মতিন ভাই জানেন না তুমি চাকরি করবে?
–না। আমাকে ঘরে বন্দি করার প্ল্যান করছে। আপনি যদি চাকরি দেন আমি প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষাটা দিয়ে দেব। আমার বন্ধুরা আছে। নোট ফোট নিয়ে নেব। কোনও অসুবিধে হবে না।
–দেখ যা ভাল বোঝ।
আমার আনন্দিত চোখ দেখে মনজু কাকা সম্ভবত বুঝতে পারেন আমি একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে একটি চাকরি আমার খুবই প্রয়োজন। তার আরও একটি ব্যাপার আমার খুবই ভাল লাগে তা হল একবারও আমাকে তিনি বলেননি স্বামীর সংসারে ফিরে যাও, মানিয়ে নিতে চেষ্টা কর এই সব বোগাস কথা বার্তা অথবা তোমার বাবা না চাইলে কী করে চাকরি করবে এইসব।
মনজু কাকা ব্যস্ত হয়ে পড়েন কাজে। আমি তার রুমের সোফায় বসে থাকি। তিনি ফাঁকে ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলেন–প্রথম অল্প বেতন পাবে। ধীরে ধীরে বাড়বে। আপত্তি নেই তো!
আমি হেসে বলি–কোনও আপত্তি নেই। এখানে যে এত বড় প্রাপ্তি যোগ তা কল্পনাই করিনি। আপনার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
ঠিক হয় আগামি শনিবার থেকে আমি চাকরি করতে যাব। হঠাৎ করে হয়েও গেল সব। বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হয় এত শিগরি কারও কপাল কী খোলে! আমি তো কপাল পোড়া মেয়ে, আমার ভাগ্যে কি এত কম যোগ্যতায় আস্ত একটি চাকরি পাওয়া সম্ভব। আমার কেন যেন বিশ্বাস হয় না সত্যি সত্যি চাকরিটি আমি পেয়েছি। আমি কি করতে পারব কঠিন কঠিন সব কাজ। মনজু কাকা অবশ্য বলেছেন কাজ তেমন কঠিন নয়। চেষ্টা থাকলেই সব হয়।
১৪. দরজায় তালাবন্ধ করে রাখা
দরজায় তালাবন্ধ করে রাখা হয় আমাকে। বাবা বলেন–আমার মেয়ে হয়ে যা তা করে বেড়াবে, এ আমি সহ্য করব না।
দরজার তালা খুলে মা আমাকে তিনবেলা খাবার দিয়ে যান। এ যে কী অসহনীয় অবস্থা তা আমি ছাড়া আর বুঝবে কে। আমার কান্নাও পায় না আজকাল। বরং জেদ হয়। ভীষণ এক জেদ হয় আমার। এইসব আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। দরজা ভেঙে বেরোব, এ আমার শক্তিতে কুলোবে না, শরীরের শক্তিতে না পারি, মনের শক্তিতে কখন দরজা খুলে বেরিয়ে যাই, বেরিয়ে চাকরি বাকরি করি, পড়াশুনা করি, যেমন খুশি থাকি, যেমন ইচ্ছে বাঁচি।
শনিবার পার হয়ে যায়। আমার বেরোনো হয় না। আলতাফের পরামর্শে আমাকে আটকে রাখা হচ্ছে এরকম ধারণা করি। আমার বাবা মা আমার ব্যাপারে নির্মম জানি কিন্তু এত নির্মম তা আমার বিশ্বাস হয় না। এভাবে আটকে থাকব আমি কতদিন, আমাকে তো বেরোতেই হবে। বাড়িতে ফিসফিস বলাবলি হয় আমি যেহেতু লতিফ নামের এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যেতে চাচ্ছি, তাই আমাকে আটকে রাখা হচ্ছে। এসবের কোনও প্রতিবাদ করতেও আমার ঘৃণা হয়। তাদের ভুল একদিন ভাঙবেই, যদি মন বলে কিছু থাকে তাদের, অনুতপ্ত হবে নিশ্চয়। ঘরের দু’একটা বই নাড়া চাড়া করি। পড়ায় মন বসে না। লেখায়ও না, লিখতে গেলেই দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে, কাকে লিখব, কে আছে আমার আপন। খুব দুঃখের রাতে কার কথা ভেবে চোখের জল ফেলব, এমনিই নিঃস্ব আমি, এমনই একা; আমাকে এই সভ্য দেশে, একটি সভ্য শিক্ষিত পরিবারে তালাবন্ধ করে রাখা হয়, কথা বলবার, চলবার, ফিরবার সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
একদিন দুপুরে মা ভাত নিয়ে ঘরে ঢুকতেই, তখন সাতদিন কেটেছে আমার ঘরবন্দি জীবন, আমি মাকে এক ঝটকায় সরিয়ে চলে যাই ঘরের বাইরে। বাঘের অরণ্য থেকে হরিণ যেভাবে পালায়, আমিও উধশ্বাসে ছুটি, কোথায় যাব কোনদিকে যাব না ভেবেই ছুটতে থাকি। পরনে আমার মলিন জামা কাপড়। রাস্তার লোকের চোখে কৌতূহল উপচে পড়ে, একটি মেয়ে এমন দৌড়োয় কেন। পেছনে ফিরি না। পেছনে আমার ধরবার জন্য ছুটে আসছে কিনা বুনো মোষের দল–ফিরে দেখি না। একটি স্কুটার নিয়ে সোজা চলে আসি পাপড়িদের বাড়িতে। পাপড়ি অবাক হয় না। সব জানবার পর বলে–নো প্রবলেম, তুই থাক কদিন আমাদের বাড়িতে। দুর্গতি যেমন আমার জীবনে বারবারই আসে, হঠাৎ হঠাৎ সাফল্যও কোত্থেকে জানি না হাতের মুঠোয় চলে আসে। চারদিক বিরূপ যখন, তখনই দেখি কারও প্রসন্ন মুখ। সকলেই যখন ফিরিয়ে নেয় চোখ, ধু ধু শূন্যতার ভেতর কেউ হয়ত বাড়ায় তখন ভালবাসার হাত। পাপড়ির বাবা শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান মানুষ। আমাকে বললেন সাহস যখন করছ, মাঝপথে থেমে যেও না। গন্তব্যে পৌঁছুবার চেষ্টা করো। ইচ্ছে থাকলে কী না হয়। বাধা তো থাকবেই পদে পদে। এগোয় তো অনেকেই, বাধা পেয়ে বেশির ভাগই থেমে যায়।
পরদিন সকালে মতিঝিল যাই, চাকরিটি আমার প্রয়োজন। মনজু কাকা আমাকে বসিয়ে রেখেই এপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি করে দিতে বলেন এডমিনিস্ট্রেশান অফিসার জালাল সাহেবকে। ছোট কাজ, আত্মীয় বলে খাতির নেই। টেলিফোন অপারেটর কাম অফিস এসিসটেন্ট। বেতনও খুব বেশি নয়। তিন হাজার টাকা।