–পড়াবে কে শুনি? বাবা তো পড়াতে চাইছেন না। বলছেন আবার ওই স্কাউড্রেলটার ঘরে যেতে।
পাপড়ি বলে–তুই টিউশনি করে পড়ার খরচ চালা। মালা কী করছে, দেখিস না? বাবা মারা গেছে। ভাই খরচপাতি দেয় না। সে দুটো টিউশনি করছে, পড়ছে।
পাপড়ির বাড়ির লনে বসে গল্প করি। খানিক পর পর চা আসে। আমি কে, কী নিয়ে কথা বলছি ইত্যাদি জানবার জন্য কেউ উঁকি ঝুঁকি দেয় না। সারাদিন কাটিয়ে সন্ধের আগে আগে ঘরে ফিরি। ফিরে দেখি বাবা মা পায়চারি করছেন। আমি কোথায় গেলাম, বাড়ি থেকে কারও হাত ধরে পালোম কি না ভাবছেন।
–কী কোথায় গিয়েছিলি? বাবার দাঁত খিচানো প্রশ্ন।
–পাপড়ির বাড়িতে।
–মিথ্যে কথা বলছিস কেন, তুই লতিফের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি।
–যদি তাই ভাবো তো, তাই। আমি খুব নির্বিকার উত্তর করি।
–এত সাহস তুই পেলি কোথায়?
–জানি না। আমার শান্ত কণ্ঠস্বর।
–জানি না বললে তো চলবে না। জানতে হবে। লতিফকে তুই বিয়ে করবি ঠিক করেছিস?
–তাও জানি না।
আমি কাপড় না পাল্টে শুয়ে পড়ি।
বাবা মা ধারণা করেন আমি প্রেমে অন্ধ হয়ে জগৎ সংসার ভুলে গেছি। আমার মাথার ঠিক নেই। তারা অনেক রাত অবধি জেগে থেকে আমার ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। আর আমি রাত জেগে কেবলই ভাবি কী করে পড়ালেখাটা করা যায়, কী করে টিউশনি যোগাড় করা যায়। কী করে মুক্ত হওয়া যায় নোংরা সংসারতন্ত্র থেকে। বুঝে পাই না। রোকেয়া হলে মালার সঙ্গে দেখা করলে সম্ভবত কিছু বুদ্ধি পাওয়া যাবে। এই ভেবে আপাতত নিশ্চিন্ত হই।
পরদিন সকালে যখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হই, মা চমকে ওঠেন আশংকায়, বুঝি মেয়ে তার এবার পালাচ্ছেই লতিফের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করেন–কেথায় যাচ্ছিস?
–রোকেয়া হলে।
–কেন?
–কাজ আছে।
–কী কাজ?
–আছে।
–আছে বললেই তো হবে না। আমাদের বলতে হবে কী কাজের জন্য, বাইরে যাচ্ছিস তুই। যেতে হলে কাউকে নিয়ে যা। কেউ তোর সঙ্গে যাক।
–সঙ্গে যেতে হবে কেন? আমি কি পথ চিনি না?
–পথ চিনলেও তোকে একা যেতে দেওয়া হবে না।
–আমি যাবই, পারলে আটকাও তোমরা।
মাকে হতবাক করে আমি সোজা বেরিয়ে আসি বাড়ি থেকে। এ বাড়িটিও শ্বশুর বাড়ির আকার নিচ্ছে। নরক কে বলে পৃথিবীর বাইরে কোথাও থাকে? নিজের বাবা মাই আমাকে অপমান করছেন, এর চেয়ে মন্দ আর কী হতে পারে। চোখে জল জমে যায়। হাতের পিঠে মুছে নিয়ে হাঁটতে থাকি। রোকেয়া হলে মালাকে পাওয়া যায় না। ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খুঁজে বের করি। কোনও রাখ ঢাক না করে বলি–টিউশনি খুঁজে দাও। কলেজে ভর্তি হব। পড়ালেখাটা আমার করতেই হবে। ইন্টারমিডিয়েটে চাকরি জুটছে না। আর চাকরি কেন করব, স্বামী থাকতে এসব জিজ্ঞেস করবে তো! এসবের উত্তর হচ্ছে স্বামীটি দেখতে ভাল, কিন্তু ওর প্রবলেম আছে মানসিক শারীরিক দুই-ই।
সে কমপ্রোমাইজ চাচ্ছে আমি কোনও কমপ্রোমাইজে যেতে চাচ্ছি না।
মালা সেদিনই কিছু জানাতে পারল না। বলল–আর কদিন পরে এস, দেখি কিছু করতে পারি কি না। সময়ের অভাবে দুটো টিউশনি ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওখানে বলে দেখব তোমার কথা।
মনে মনে হুররে বলে উঠি। কখনও ভাবতে পারি নি নিজের জন্য নিজেই কিছু করা যায়। সচ্ছল বাবার সংসার থেকে সচ্ছল স্বামীর সংসারে বাকি জীবন কাটাতে গিয়েছিলাম। ওরা খেতে পরতে দেবে, বিনিময়ে যা নয় তা শুনতে হবে আমার, এক খাওয়া পরার জন্য নিজেকে অসম্মান করতে দেব কেন?
মালার সঙ্গে কথা বলতে বলতে লাইব্রেরী গেটের কাছে দাঁড়াই। কোন দিকে না। ভেবেই একটি রিক্সা নিই। রিক্সা দোয়েল চত্বরের দিকে যেতে থাকে। বাড়িতে যাব ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায়। অন্য কোথাও যদি যাওয়া যেত। দূরে কোথাও। এই চেনা শোনা পরিবেশ থেকে দূরের শহরে। রিক্সা যখন প্রেসক্লাব পার হয়ে যেতে থাকে, তখনও আমি জানি না মনজু কাকার অফিসে যাব। হঠাৎই মনে পড়ে মনজু কাকার কথা। আমার এক দূর সম্পর্কের কাকা, ইণ্ডাষ্ট্রি আছে মতিঝিলে। কাকা আমেরিকা ছিলেন, দেশে এসে ইণ্ডাষ্ট্রি দিয়ে বসেছেন। এখন দেশেই থাকবার চিন্তা ভাবনা করছেন। পাঁচ ছ বছর কোনও যোগাযোগ নেই। তাঁর কথা আমার মনে পড়বার কথা নয় বা তার কাছে আমার যাবার কথা নয়।
হঠাৎ মনে পড়ায় যাই সময় কাটাতে। বাড়ি ফিরলে আবার তো সেই হুল ফোঁটানো কথা। আমার ভাল লাগে না নিরন্তর সংসার সংসার স্বামী স্বামী বলে একটানা চিৎকার। চিৎকারই মনে হয় এসব। স্বামী দিয়ে যদি আমার সুখ না হয়, তবু স্বামীর কাছে পড়ে থাকতে হবে আমার, বাবা মার মুখ রক্ষা করতে। আমার জীবনের চেয়ে তাদের মুখের মূল্য যেন বেশি।
মতিঝিলে মনজু কাকাকে পেয়ে যাই। কাকা দেখে অবাক—তুমি এখানে?
–হ্যাঁ এলাম। করার কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না তো, তাই।
–বস বস। বাড়ির সবাই ভাল আছে? তোমার হাসবেন্ডের খবর কি। শুনলাম বিয়ে টিয়ে হয়েছে। আমরা তো দাওয়াত পেলাম না।
মনজু কাকার পঞ্চাশ হবে বয়স। এখনও তারুণ্যে ভরা হৃদয়। ছেলে মেয়ে সব বিদেশে। ওরা কোথায় কী পড়ছে বললেন। আমি পড়াশুনা কতদুর করেছি জিজ্ঞেস করলেন। লজ্জাই পেলাম বলতে যে মাত্র ইন্টারমিডিয়েট অবধি পড়েছি। বললাম-বিএ ভর্তি হব। সঙ্গে টিউশনি করব।
–কেন? টিউশনি করতে হবে কেন? এনি প্রবলেম?