আলতাফের সামনে বাবা মার অপরাধি মুখ। যেন আমাকে সে নিয়ে যাবে বলে তারা কৃতার্থ। যেন আলতাফ লতিফের সঙ্গে আমি প্রেম করবার পরও এ বাড়িতে এসে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে।
আমি শুয়েছিলাম। শোয়া থেকে না উঠেই বলি–আমি যাব না।
–যেতে হবে।
–যাব না তো বললাম। কণ্ঠে আমার আশ্চর্য দৃঢ়তা কাজ করে।
যাব না তো যাবই না। আমাকে টানা হেঁচড়া করেও কোনও লাভ হয়নি। আমি যাইনি। আমি যাচ্ছি না দেখে আলতাফের গা কাপছিল রাগে। নিজের বাড়ি হলে ও আমাকে ছিঁড়ে ফেলত। এ বাড়িতে মাথা নিচু করে বাবা মাকে বলেছে–আপনারা পরে নিয়ে আসুন না হয়। যদি এখন থেকে ভাল হয়ে চলে তবে আমি কেন আপত্তি করব বলুন। আমি কষ্ট করে চলব। আমার আর কী। আমার জীবনের আর মূল্য কী বলুন। আমি তো ওর জন্যই। ওর কী করে সুখ হবে তাই ভাবি। ওর যেন কোনও কষ্ট না হয় সেই চেষ্টাই দিনরাত করে যাচ্ছি। বলতে বলতে আলতাফের চোখে জল চলে আসে।
.
আলতাফ চলে যাবার পর শুরু হয় আমার ওপর নতুন রকম অত্যাচার। মা কাঁদো কণ্ঠে বলেন–এই মেয়ে জন্ম দিয়ে আমি পাপ করেছি। ভেবেছিলাম মেয়ে সুখি হবে। সবাইকে গর্ব করে বলতে পারব মেয়ে আমার ইঞ্জিনিয়ারের বউ। মা মিহি সূরে কাঁদতে থাকেন। বাবা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। মামা কাকারা বলেন–বিয়ের পর স্বামীর ঘরই আসল ঘর। মান অভিমান একটু আধটু হয়েই থাকে। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এদিকে আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এ বাড়িতেও আমি থাকব না। কোথাও চলে যাব। এ বাড়িটিকে, আমার জন্ম থেকে চেনা বাড়িটিকেও আমার অচেনা মনে হয়, পর মনে হয়। বাসযোগ্য মনে হয় না। আমি যে আলতাফের সঙ্গে না গিয়ে অত্যন্ত অন্যায় একটি কাজ করেছি তা আমাকে হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেয় এই বাড়ির সদস্যরা। আমি অসহায় বোধ করি। ছটফট করি ভেতরে ভেতরে।
১৩. একটি চাকরি খুঁজতে থাকি
আমি একটি চাকরি খুঁজতে থাকি। চেনা পরিচিত ক’জনকে ফোনে বলি কোথাও কোনও কাজ টাজ পাওয়া যায় কি না দেখতে। সবাই অবাক হয়। বলে–তুমি চাকরি করবে কেন? তোমার না বিয়ে হয়েছে!
আমি বলি–বিয়ে হলে বুঝি চাকরি করতে নেই?
–স্বামী শুনেছি ইঞ্জিনিয়ার।
–স্বামী ইঞ্জিনিয়ার সে তো স্বামীর ব্যাপার। আমার নয়।
–তোমারও কিছু হতে হবে নাকি? তার টাকাই কি তোমার টাকা নয়?
–তার টাকা আমার টাকা হতে যাবে কেন? কোনও অর্থেই তার টাকা আমার টাকা নয়।
–কেন, সে কি টাকা পয়সা দেয় না? এটা ওটা কিনে দেয় না?
–তা দেবে না কেন? দেয়। কিন্তু সে তো তার দান হল। আমার নিজের তো কিছু হল না।
–নিজের আবার আলাদা করে লাগে না কি?
–নিশ্চয় লাগে। আমি যেহেতু একজন আলাদা মানুষ। কারও দ্বারা কোনও সাহায্য হয় না। বরং নানা রকম উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় আমাকে। আর আমিও আশ্চর্য হই আমার এই বোধ জন্মালো কী করে যে আমাকে একজন আলাদা মানুষ হতে হবে। আমার বাড়ির পরিবেশ আমাকে এই বোধ জন্মাতে দেবার কথা নয়। তবে কি এসব নিজের ভেতরেই জন্মেছে! আপনা আপনি! নাকি আলতাফের স্বামী আমাকে সচেতন করিয়েছে যে স্বামীত্বের আরেক নাম প্রভুত্ব। আর তার প্রভুত্ব মানবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না বলে আমার ভেতর অবচেতনেই জন্ম নিয়েছে একটি সত্ত্বা অর্জনের তাগিদ।
বাড়ি থেকে বেরোই। অনেকদিন এখানে গুমোট অন্ধকারে বসে ছিলাম। এখানেও কেমন দম বন্ধ লাগে। ধানমণ্ডিতে পাপড়ির বাড়ি, রিক্সা করে ও বাড়িতে যাই। বন্ধুদের মধ্যে ওকেই আমার সাহসী মনে হয় সবচেয়ে বেশি। এই বয়সে ইণ্ডিয়া ঘুরে এসেছে একা একা। ওর বাবা বলেন বাইরে একা ঘোরা অভ্যেস করা দরকার। মেয়েগুলো ঘরে বসে থাকতে থাকতে ইঁদুর হয়ে গেছে। জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানে না তারা।
আমার কী যে ভাল লাগে শুনে। পাপড়ির বাবার মত কেন আমার বাবা নন-মনে মনে এই নিয়ে আমার দুঃখও হয়েছে খুব।
আলতাফের কাছ থেকে চলে এসেছি শুনে পাপড়ি বলল–চেষ্টা করে দেখ থাকা যায় কি না।
আমি বললাম–না রে কোনও উপায় নেই। একজন ইমপোটেন্ট লোকের ঘরে বসবাস করার চেয়ে গরু ছাগলের সঙ্গে থাকা ভাল।
–বলিস কী! ইমপোটেন্ট লোককে বিয়ে করতে গেলি কেন?
–আমি কী জানতাম সে ইমপোটেন্ট?
–তাই তো কথা। তোর তো জানার কথা নয়। তোর বাবা মাকে বলেছিস?
–ওঁরা আগে থেকে এত উল্টো পাল্টা কথা বলছেন যে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। ওঁরা ধরেই নিয়েছেন যে আমি এক ছেলের প্রেমে পড়ে স্বামীর ঘর ছেড়েছি।
বাড়িতে আমাকে উদ্দেশ্য করে কী অশালীন এবং অসভ্য কথাবার্তা হয়, ভেবে, এই প্রথম, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাপড়ির বাড়ি এসে, আমি কেঁদে উঠি।
পাপড়ি আমাকে জড়িয়ে ধরে। বলে–ডোন্ট ওরি, বী হ্যাপি। তুই যদি চলেও আসতি কারও সঙ্গে কার কী বলার ছিল। চিয়ার আপ। ও আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে–জীবন তোর শুরু হল মাত্র, এখনই পেছনের ঝুটঝামেলা নিয়ে ভাবছিস কেন। আলতাফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবার পর কারও সামান্য স্নেহের স্পর্শ পাইনি। পাপড়ির এই ‘বী হ্যাপি উচ্চারণ আমাকে অনাবিল আনন্দ দেয়। অনেকদিন ভুলেই ছিলাম আনন্দ কি জিনিস।
পাপড়ি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইংরেজিতে অনার্স! জিজ্ঞেস করি–যদি আমিও পড়তে চাই।
–পড়তে চাইলে পড়বি।