আমি হঠাৎ হঠাৎ নিজেকে প্রশ্ন করতাম আলতাফের বাড়িতে আমি থাকি কেন? প্রশ্নের উত্তর অবশ্য নিজেই পেতাম, যেমন আলতাফকে আমার সুখ দিতে হবে, শারীরিক এবং মানসিক সুখ; আলতাফের ঘরবাড়ির শোভা আমাকে বৃদ্ধি করা। নিজেকেই আবার প্রশ্ন করতাম আমার শোভা কে বৃদ্ধি করবে? আমার শোভা তো আমার ত্বকের রঙ ও মসৃণতা, আমার চুলের দৈর্ঘ্য, আমার কোমর নিতম্ব আর বুকের গঠন–সে আমাকেই তলে তলে রক্ষা করতে হবে। মা যেমন বিয়ের আগে চুল এবং ত্বকের যত্ন করতে শেখাতেন, বিয়ের পর সেই প্রক্রিয়াকেই টেনে নিতে হবে। স্বামী আমাকে শোভা বর্ধক দেবে, অর্থাৎ শাড়ি দেবে, গয়না দেবে, কসমেটিকস দেবে। বিনিময়ে তাকে আমার জীবনের সবটুকু দিতে হবে। আমার মান মর্যাদা, ব্যক্তিত্ব সব। আমার কোনও পৃথক ইচ্ছে টিচ্ছে, আমার কোনও স্বপ্ন সাধ তখন আর স্বীকৃত নয়। আর কবেই বা ইচ্ছের মর্যাদা পেয়েছি? এই যে বিয়ে বসেছি, এই যে আমার লেখাপড়া হঠাৎ থামিয়ে আমি স্থবির জীবনে প্রবেশ করতে এতটুকু কুণ্ঠিত হইনি–সে তো দশটা লোকের শেখানো বলে। আমি আমার দাদি নানি মা খালা ফুপুর কাছে শিখেছি যে ছেলেরা মনে যা চাইবে তা করবে আর মেয়েরা, ছেলেরা যা করাবে, তা করবে। দাদি নানি মা এঁরা কখনও তাঁদের স্বামীদের আদেশ ছাড়া এক পাও বাইরে বেরোতো না। আমাকেও তারা সেরকম শেখাতে চাইছেন যে আমিও যেন তাদের মত হই, সমাজের আর দশটা মেয়ে মানুষের মত হই। আমি অবশ্য সেরকমই গড়ে উঠছিলাম, সেরকম করেই আমার বোধ বুদ্ধির সীমানা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু অল্প অল্প করে সীমানা অতিক্রম করবার ইচ্ছে হল আমার। কেন হল, কী করে হল আমি বুঝতে পারি না। তবে এটুকু বুঝি, হল বলেই আমি স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছি। একা বাবার বাড়ি উঠে আমি বলতে পেরেছি–’হ্যা একলা এলাম।‘
কেন এলাম এই প্রশ্ন উঠেছে। মধ্যরাত পর্যন্ত পারিবারিক বৈঠকে এই প্রশ্ন নিয়ে সবাই মাথা ঘামিয়েছেন। আমি কিছুই বলিনি। নিরুত্তর থেকেছি। আমার নিরুত্তর থাকা নিয়ে ওঁদের কৌতূহলের শেষ নেই। ওঁদের বিস্ময়ের সীমা নেই। তারপর যখন স্বামী শাশুড়িরা আমাকে নিয়ে আসতে গেলেন আমার ইচ্ছে ছিল না আসবার। আসতে হল কারণ কার কাছে থাকব আমি? বাবা মা ভাইদের কাছে? ওঁরাই তো আমাকে রাখতে রাজি নন। ওঁরাই তো আমাকে ঠেলে পাঠান স্বামীর বাড়িতে।
০২. আলতাফ মদ খায় না
আলতাফ মদ খায় না। মেয়েমানুষ দেখলে ছোঁক ছোঁক করে না। সবই আমি স্বীকার করি। সে কি আমাকে গালমন্দ করে? না তাও করে না। বরং বুকের মধ্যে জড়িয়ে। বলে ‘ও আমার হীরে। ও আমার সোনা বউ।‘ অফিস থেকে ফিরেই ‘হীরা হীরা হীরা। হীরা কাছে বস। হীরা হাসো। হীরা মুখ তোল। হীরা কী আর মুখ তোলে! হীরার তো মুখ তুলতে ইচ্ছে করে না। হীরা তুমি কি খেতে ভালবাস? চল আজ সোনার গায়ে খাই। চল লং ড্রাইভে কোথাও যাই। হীরার কি আর যেতে ইচ্ছে করে। ভাল না লাগায় পেয়েছে তাকে। সে কেন যাবে?
মা আসেন। আশংকা তিরতির করে কাঁপে তাঁর চোখের তারায়। আমাকে আড়ালে ডেকে মা জিজ্ঞেস করেন–আলতাফ কি তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে? আমি জানালায় উদাস তাকিয়ে উত্তর দিই–না।
–তোর শ্বশুর শাশুড়ি, ওঁরা কী তোকে ভালবাসেন না? মা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন।
–বাসেন। আমি দু’আঙুলে জানালার শাদা গ্রিলগুলোর ময়লা তুলতে তুলতে বলি।
–আর আলতাফ?
–আলতাফও। আমার স্বরে যথেষ্ট সংযম।
–সময় মত ফেরে অফিস থেকে?
–ফেরে।
–তোকে কি রান্নাবান্ন করতে বলে?
–না। ও তো কাজের লোকেহ করে।
— বেড়াতে টেড়াতে নয়?
–হ্যাঁ নেয়। সেদিন চিটাগাং গেলাম।
–তবে? তুই থাকতে চাস না কেন? হয়েছে কী তোর?
এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। আমি বোঝাতে পারি না কেন আমার ভাল লাগে না। কেন আলতাফের মত চমৎকার এক যুবককে আমি ভালবাসতে পারছি না। কেন এক হৃদয়বান চরিত্রবান স্বামীর ঘর ছেড়ে আমি বারবারই চলে যেতে চাই। বাবাও একদিন গুলশানে আমার স্বামীর বাড়ি এলেন। থমথমে মুখ। তাঁকে বললাম–বস চা টা দিই। না তিনি বসবেন না। আমার সঙ্গে জরুরি কথা বলবেন।
–কী কথা?
–তোর প্রব্লেম কী বল?
–প্রব্লেম মানে?-
-তুই বাড়ি যাবার জন্য কান্নকাটি করছিস?
–হ্যাঁ করছি।
–কেন? তোর কি খাওয়া পরার অভাব?
–না।
–যা দরকার আলতাফ কি সব দেয় না?
–মানে?
–মানে এই কসমেটিকস্, শাড়ি কাপড়, যখন যা লাগে টাকা পয়সা?
–হ্যাঁ দেয়।
–তবে?
এর কোনও উত্তর আমি দিতে পারি না। বাবা আমাকে যাবার সময় বলেন ‘আসলে প্রব্লেম তুই নিজেই। এত ভাল একটা ছেলে পেয়েছিস, মনে ধরছে না। আলতাফ হীরের টুকরো ছেলে, ওকে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ঢাকা শহর খুঁজে বার কর তো এরকম দ্বিতীয় একটি ছেলে! তোর এত অহংকার কিসের? বেশি সুখে আছিস তো, টের পাচ্ছিস না। এখনও সময় আছে নিজেকে সংশোধন কর।‘
নিজেকে সংশোধনের কিছু খুঁজে পাই না আমি। আমার কোনও কিছু নিয়ে আলতাফ এখন পর্যন্ত আপত্তি করেনি। আমি যে বিয়ের একমাসের মাথায় বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম এ নিয়েও আলতাফ কিছু বলেনি, একবারও জিজ্ঞেস করেনি কেন গিয়েছিলে, বরং চলে যে এলাম তাতেই বোধহয় ও একটু অবাক হয়েছে। অবাক হবার তো কথাই। আসলে যত আপত্তি আমার বাবা মায়ের, শ্বশুর শাশুড়ির। আমি নাকি মনমরা বসে থাকি সারাদিন, খেতে চাই না, কথা টথা বলি না বেশি, সাজি না, ভাল একটা শাড়ি পরি না, বিয়ের পর বউরা একটু সেজেগুঁজে না থাকলে চলে! শাশুড়ি প্রায়ই আলতাফকে বলেন-’কীরে তোর বউএর হয়েছে কী বল তো। শরীর খারাপ?’