আলতাফ দ্রুত বাস ফেলে। রাগে সে কঁপে। আমি একটি মাঝারি ব্যাগে কিছু কাপড় নিয়ে বলি–যাচ্ছি।
আমার একবারও মনে হয় না স্বামীর ঘর থেকে বের হওয়া উচিত নয়। আলতাফের জন্য, আলতাফের বাবা মার জন্য, এই বাড়ির জন্য আমার কোনও মায়া হয় না। বরং মনে হয় এই নরক থেকে পালাতে পারলে আমি বাঁচি। সদর দরজা খুলে বেরিয়ে যাই। কেউ আমাকে বাধা দেয় না। বাইরে পা দিয়ে, আমার বেশ ফুরফুরে লাগে। যেন এতদিনে আমার একটা গতি হল। আমি বুক ভরে শ্বাস নিই। বাইরের আলো হাওয়া জানালার ফাঁক ফোকর গলে যা ভেতরে যেত, সেইটুকুই পেয়েছি। এত বড় একটা আকাশ কতদিন দেখি না। এত বড় জগত, এখানে আমাকে এখন বাধা দেবার কেউ নেই। আমার যেমন ইচ্ছে আমি চলব। পেছনে ফিরতে আমার ইচ্ছে করছে না। পেছনে আমি ফিরব না। আমি সামনে হাঁটতে থাকি। কতদিন হাঁটি না আমি। কত দীর্ঘদিন আমি একটি বন্ধ ঘরে দম আটকে কাটিয়েছি। ভাবলে মায়া হয়, নিজের ওপরই মায়া। হাঁটতে থাকি। সামনে যানবাহন কিছু একটা পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। আবারও বাস নিই বুক ভরে। নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে মনে হয়। হাতের ব্যাগটিকেও ভার ভার লাগে। এটি নিয়ে আসাই উচিত হয়নি। কোথাও ফেলে দেওয়া যায় না? রাস্তায়? নির্ভার রাখতে চাই নিজেকে। দূর, কী আর আছে এর ভেতর গুটিকয় কাপড় ছাড়া? ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। দিই না ফেলে? কী হবে! কী হবে এই সব তুচ্ছ বৈষয়িক জিনিসে?
ঠিক ঠিকই আমি ফেলে দিলাম কাপড়ের ব্যাগ। হাতে আর কোনও বোঝা নেই। মনেও নেই। মুক্ত আমি, মুক্ত আমি শরীরে মনে। এরকমই তো চেয়েছিলাম। এরকম মুক্ত নির্ভার জীবন। এরকম স্বাধীন সুস্থ জীবন। আহ, কী ভীষণ ভাল লাগা। আমার এক মামা বাম রাজনীতি করত, জেল খেটেছিল একবার, এক বছর মত জেলে কাটাবার পর যেদিন বেরিয়ে এল, চারদিক তাকাচ্ছিল শুধু। কী দেখছ মামা জিজ্ঞেস করলে বলেছিল–পৃথিবীটা কী সুন্দর তাই না?
আমার সেরকমই লাগছে। পাশে কেউ নেই, থাকলেও আমিও বলতাম–বাইরে এত বড় জগৎ রেখে বোকা ছাড়া কেউ বসে থাকে ঘুপচি ঘরে! এত আলো রেখে কেউ পড়ে থাকে অন্ধকারে? এত মানুষ রেখে বাইরে, কেউ পড়ে থাকে এমন একা, আমি যেমন ছিলাম! এই আকাশ এখন আমার। আমারই তো। এই যে পথ, এই পথে আমার যেমন ইচ্ছে হাঁটব। আমি যেদিকে খুশি যাব। অন্ধকার নেমে আসছে, আমার কোথাও ফিরবার তাড়া নেই।
১২. ও কেন তোকে মারবে
বাবা বলছেন–আলতাফ ভাল ছেলে। ও কেন তোকে মারবে?
মা বলছেন–মেরেছে যখন কোনও কারণ আছে নিশ্চয়।
আমি অবাক হই ওঁদের নির্বুদ্ধিতায়। প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয় না। তবু মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়–দোষ ওরই।
বাবা, মা, এমন কী দাদাও আমাকে বলছেন–কোন কারণ ছাড়া আলতাফ মারবে কেন? দোষ না করলে কেউ মারধোর করে? আলতাফ তো আর অশিক্ষিত ছেলে নয়।
রাতেই টেলিফোন করে আলতাফ, বাবাকে বলে–কেমন আছেন আব্বা। আপনার মত আদর্শবান মানুষের মেয়ে যে কেন এমন হল আমি ভাবতে পারছি না। আমার ফ্রেণ্ড সারকেল সব জেনে গেছে ব্যাপারটা। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করছে। তো আমি বলে যাচ্ছি এসব ঠিক নয় আর আমার স্ত্রীর ব্যাপার আমি বুঝব। আর কতদিন এভাবে সামাল দেব জানি না। মানুষ তো আমি, কী বলেন? লতিফের সঙ্গে সে শুয়েছে। কী করে পারল সে আমি বুঝি না।
বাবা মা মুখ চুন করে বসে থাকেন। অনেক রাত পর্যন্ত বাড়িতে মিটিং চলে। মামারা আসেন, কাকারা আসেন, তারা সবাই একটি সিদ্ধান্তে আসেন, সে হল আমার মাপ চাইতে হবে আলতাফের কাছে। সিদ্ধান্তটি আমাকে জানানো হলে আমি বলে দিই, মাপ আমি চাইব না।
কেন আমি মাপ চাইব না? এত সাহস আমি কোথায় পেলাম? এইসব জানতে চাওয়া হয় আমার কাছে। আমি বলি–জানি না কোথায় পেলাম সাহস। তবে সাহর্স পেয়েছি। সাহস থাকা তো ভাল।
বাড়ির সবাই অবাক হয়, ভালই তো ছিল মেয়েটি, কোনও ‘ব্যাড রেকর্ড’ ছিল না, তার এমন চরিত্র খারাপ হল কবে? চরিত্র যে আমার খারাপ হয়েছে এ ব্যাপারে ওরা নিশ্চিত। কপালে আমার সুখ সইল না–এ নিয়ে ওরা দুঃখ টুখও করে।
আমি কাউকে বোঝাতে পারি না আলতাফের প্রবলেমের কথা। মাকে হয়ত বলা যেতে পারত, কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছে হয় না। তিনি ভেবেই নিয়েছেন দোষ আমার। যে মানুষ আমাকে এতটা অবিশ্বাস করতে পারেন, তাঁকে আমার গভীর গোপন সমস্যার কথা বলতে রুচি হয় না, হয়ত সব শুনে বলেও বসতে পারেন, দোষ আমারই। তাকে তো আর একজন অক্ষম পুরুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে হয়নি, রাতের পর রাত নিঘুম কাটাতে হয়নি। তিনি কী করে বুঝবেন শরীরের যন্ত্রণা এক সোমখ নারীকে কতটা উন্মাদ করে। শরীর ভরে কী ভীষণ তৃষ্ণা থাকে অতৃপ্ত নারীর, তা পরিতৃপ্ত নারীরা বুঝবে কেন। আমি সারাদিন এ বাড়িতেও একটি নিঝুম ঘরে বসে থাকি। এখানেও আমার বড় একা লাগে।
ফুপুও আগের মতন তেমন কেয়ার করে কথা বলেন না। কণ্ঠস্বরে তাচ্ছিল্য টের পাই। একদিন বলেন–তোমার ভবিষ্যত ভেবে দুঃখই লাগে।
আমি বলি–দুঃখ লাগার কী আছে।
ফুপু বলেন–ভাবছি, এই স্বামী যদি তোমাকে না নেয় তবে কী গতি হবে তোমার!
–স্বামী নিতে চাইলে আমি যাব, কে বলেছে তোমাকে?
–স্বামীর ঘরে যাবে না তো কোথায় যাবে?
–যেখানেই যাই, ওই বাড়িতে আর না।