–তার মানে পুরোপুরি সারেণ্ডার করতে হবে? লতিফ চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে।
–তা না করলে খিটিমিটি। ঝাঁটার মার।
দুই বন্ধু হেসে ওঠে। আমি নির্বাক বসে থাকি। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। এসব কী শুনছি আমি! আলতাফ যে আপাদমস্তক স্ত্রৈণর মত কথা বলছে। লতিফ চলে যায়। দুজন দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ি। দরজা লক করে দিয়েই আলতাফ বলে–কখন এসেছিল লতিফ?
–চারটেয়।
–আমি বাড়িতে আসি পঁচটায়, ও চারটার সময় এসেছিল কেন?
–সে আমি কী জানি।
–তুমি নিশ্চয়ই জানো। তোমার সঙ্গেই যেহেতু গল্প করছিল।
–বাড়িতে যখন এসেছে রমজান গেট খুলে দিল। মা-ই বললেন। আমি তাকে চিনি। তাই বসিয়েছি। কথা বলেছি। খুব অন্যায় কিছু করেছি বলে তো মনে হয় না।
–কী কী বলেছ শুনি।
–কী আর! তোমার কথাই হল।
–আমার কথা? আমার দুর্নাম করলে বুঝি?
–দুর্নাম করব কেন?
–তবে কি সুনাম? তোমরা দুজন ঘনিষ্ঠ বসে আমার গুণগান গাইছিলে?
–ঘনিষ্ঠ বসতে কোথায় দেখলে?
–আমার চোখকে ফাঁকি দিতে চাও?
–ফঁকি দেওয়ার কী আছে, বুঝতে পারছি না। লতিফ তোমার বন্ধু। তোমার খোঁজে এসেছে। যেহেতু সে আমাকে ডেকেছে, আমি কথা বলেছি। এই ভদ্রতাটুকু তো করতে হবে।
–রাখ তোমার ভদ্রতা। লতিফ কেন এসেছিল ঠিক করে বল। আগে থেকে প্রোগ্রাম ছিল?
–মানে?
–মানে বোঝ না? কচি খুকি তুমি?
–কচি খুকি না হই কিন্তু তোমার কথা আমার ঠিক মাথায় ঢুকছে না।
–মাথায় ঠিকই ঢুকবে। সময় আসলে ঠিকই ঢুকবে।
–কী বলছ তুমি?
–এই লোফারটার সঙ্গে তোমার এত ভাব কেন হল আমি বুঝি না ভাবতে চাও?
–ওর সঙ্গে ভাব হতে যাবে কেন? তুমি কিন্তু যা তা বলছ।
–আমি ঠিকই বলছি। তোমার এসব বেলেল্লাপনা আমার সহ্য হচ্ছে না।
আলতাফ অফিসের কাপড় খুলে ফতুয়া আব ট্রাউজার পরে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে। ওর দিকে তাকাতে আমার লজ্জা হয়। আমার এমন মনে হয়, সত্যিই বোধহয় লতিফের সঙ্গে আমার প্রোগ্রাম ছিল। আমার এমনও মনে হয় লতিফের সঙ্গে বেলেল্লাপনা বোধহয় করেছিই।
বারান্দায় একা বসে থাকে সে। আর আমি ভর সন্ধেয় ঘরের জানালার কাছে একা দাঁড়িয়ে থাকি। সন্ধে পার করে আলতাফ ঘরে ঢোকে। বলে–কী ব্যাপার ঘরের আলোও জ্বালোনি। খুব মনে পড়ছে বুঝি কারও কথা?
আমি কোনও উত্তর না দিয়ে জানালা থেকে সরে আসি।
–রমজানকে ডেকে চা খেতে হল! লতিফকে তো ঠিকই চা করে খাওয়ালে!
–তুমি তো বলনি চা করতে!
–বলতে হবে কেন, বুঝতে পাবো না আমার এখন চা দরকার?
আলতাফের কখন চা দরকার তা আমার বুঝতে হবে। কেন বুঝতে হবে? আমার দরকার কে বুঝবে। আমারও তো চায়ের তৃষ্ণা হয়। আমার তো আরও কিছু তৃষ্ণা হয়। আলতাফ কি কখনও জানতে চেয়েছে আমার কেন এত ভাল না লাগা? কখনও কি একবার পিঠে হাত রেখে বলেছে হীরা তোমার কষ্টের কথা বল?
–আর কী কী করলে তোমরা? আলতাফ বিছানায় আধশোয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে।
–তুমি কি বলতে চাও? আমি প্রশ্ন করি।
আলতাফ আমার কথায় ঠোঁট বাকা করে হাসে। বলে-শুধু কি গল্পই করেছ? আর কিছু করনি?
–মানে?
–মানে তো বোঝই। তোমার তো আবার পুরুষ মানুষের শখ। তাই জিজ্ঞেস করছি। আমাকে দিয়ে তোমার তো হয় না।
–কী হয় না?
–শরীর শান্তি হয় না।
–হ্যাঁ, তা তো হয় ই না। আমি কড়া কণ্ঠে বলি।
–তাই পুরুষ মানুষ নিয়ে আমার বাড়িতে তুমি ফুর্তি করছ। তোমার সাহস কত, এক লোক এসেছে আমার কাছে, আমি বাড়ি নেই সে চলে যাবে। আর তুমি কিনা আমারই বন্ধু, তাকে ঘরে বসিয়ে মজা কর।
এই সব কথা শুনতে আমার ভাল লাগছে না। আমি নিজের কান চেপে ধরি। কী শুরু করেছে আলতাফ। ও আমাকে ভুল বুঝছে। আমাকে অবিশ্বাস করছে। আমি কী করে ভাঙাব তার ভুল! আমি কী করে মুক্তি পাব অজগরের ছোবল থেকে! নিজেকে বড় একা লাগে আমার। এই জগতে আমার মত নিঃস্ব একা অসহায় আর কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না।
১১. লতিফ আবারও আসে একদিন
লতিফ আবারও আসে একদিন। হঠাৎ বিকেলে। বলে–ভাবী, আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম।
–আমার সঙ্গে? আমি অবাক হয়ে বলি–আমার সঙ্গে কী গল্প?
–খুব খালি খালি লাগছিল তো, তাই।
–খালি খালি কেন। বন্ধু বান্ধব নেই?
–সবসময় বন্ধু বান্ধব ভাল লাগে না। লতিফ সোফায় আরাম করে বসে বলে।
আমি কি কথা বলব খুঁজে পাই না। শাশুড়ি একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেছেন কে এসেছে; কার সঙ্গে কথা বলছি। আমি পড়েছি মুশকিলে। লতিফ হৈ হৈ করে ঢোকে। ভাবী ভাবী বলে ডাকে, আমাকে সামনে আসতেই হয় অগত্যা। কিছু একটা বলতে হয় বলেই বলা–বিয়ে করছেন না কেন? বিয়ে করে নিলেই তো পারেন! বউ নিয়ে বেড়াবেন। ঘুরবেন। একা একা লাগবে না।
–বিয়ে? পাত্রী কোথায় বিয়ে করার? আমার কী আর আলতাফের ভাগ্য? চাইলাম, আর সুন্দরী বউ পেয়ে গেলাম!
লতিফের কথাগুলো আমার ভাল লাগে না। আলতাফ যে বলেছিল একদিন লতিফ একটা লোফার। লতিফ একটা লোলুপ লুম্পেন। লতিফ হয়ত তাই। তা নয়ত সে আমাকে কেন বলছে তার খালি খালি লাগে! সে কি তার শূন্যতা ভরাট করতে এসেছে আমার কাছে? লতিফ আলতাফের মত লম্বা নয়, অমন সুন্দর স্বাস্থ্য আর চেহারা নেই তার। তবু দেখতে মন্দ লাগে না। হাসিতে উজ্জ্বলতা আছে তার। কামানো গালের সবুজ আভা তাকে অন্যরকম দীপ্তি দেয়। আলতাফ যে এত সুদর্শন পুরুষ, আলতাফের মধ্যে এই পৌরুষ যেন অনুপস্থিত। লতিফের দিকে আমি অপলক তাকিয়ে থাকি। লতিফও আমার চোখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়। আমি ভুলেই যাই আলতাফ আমাকে নিষেধ করেছে লতিফের সঙ্গে কথা বলতে, লতিফের সামনে আসতে। কেন আমি তার সামনে আসব না? আমি কি অন্যায় করেছি? আলতাফ আমাকে কিনে নিয়েছে? আমি তার দাসী বাদি কিছু?