এক বিকেলে, তখনও ফেরেনি আলতাফ, লতিফ আসে বাড়িতে। শাশুড়ি রমজানকে দিয়ে গেটের তালা খোলান। আলতাফের বন্ধু লতিফ। লতিফ বাড়িতে ঢুকেই ভাবী ভাবী বলে ডাকে। আমি ডাক শুনে গিয়ে বলি–আপনি বসুন, আমি, ভেতরে কাজ আছে কিছু করি।
–কী ব্যাপার এভয়েড করছেন মনে হচ্ছে। লতিফ হেসে বলে।
আমি বিব্রত হই। আসলে আলতাফের নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছিলাম। সে আবার লতিফের সামনে কেন এলাম এ নিয়ে কোনও ঝামেলা বাধায় কি না। খামোকা লতিফের অপমান।
–কী হয়েছে আপনার বলুন তো আজকাল আমাদের বাড়িতে যান না। আমরা এ বাড়িতে এলে কাছে আসেন না। শুনেছি অসুখ হয়েছিল। আর ইউ ক্যারিং?
আমি কোনও কথার জবাব দিই না। জবাব দেবার কিছু তো নেই।
লতিফ আবার বলে–আমরা আপনাকে খুব মিস করি ভাবী।
কারণ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
–কী ব্যাপার কথা বলছেন না কেন?
আমি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
ছোটবেলায় বাবা মা বকলে যখন খুব মন খারাপ হত, কোথাও একলা বসে থাকতাম, গলার কাছে কষ্ট গুলো জমে থাকত, কেউ এসে পিঠে হাত রাখলেই কেঁদে উঠতাম। লতিফের কথায় আমার কান্না পায়। আটকে রাখি।
–ভাবী, আমরা তো আপনার পর নই। বলুন কি হয়েছে। এত চমৎকার একটি মেয়ে, আপনি আপনার মুখ এমন মলিন থাকবে, এত বিপ্ন থাকবে, এ কী মানা যায়! কি হয়েছে আপনার?
–না। কী আর হবে, বাড়িতে তো অভাব কিছুর নেই।
–অভাব বুঝি কেবল জিনিসপত্রেরই হয়, আর কিছুর হয় না!
আমি চুপ হয়ে থাকি। অভাব যে কতকিছুর আছে সে আমি বুঝি। আমার হাড় মাংস মজ্জা জানে অভাব আমার শরীরকে কত তৃষ্ণার্ত করে রেখেছে।
লতিফ হেসে বলে–আলতাফের এই গুণটা খুব ভাল।
–কী গুণ? জিজ্ঞেস করতে হয় বলেই করা, এমনিতে ওর গুণ সম্বন্ধে জানবার আগ্রহ হয় না আমার। দোষ যার এত, তার গুণ আর কী হতে পারে!
–ও কিন্তু কোনও মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। বিয়ের আগে আমরা বলতাম, তোর বিয়ে করার ইচ্ছেও বোধহয় কোনও দিন হবে না।
–ও কি বলত? আমি জিজ্ঞেস করি কারণ ওর অদ্ভুত গুণটি আমাকে আকৃষ্টই করে।
–ও হাসত। হাসির কোনও অর্থ থাকত না।
–তো বিয়েই বা করল কেন?
–হঠাৎ। শুনলাম ওর বাবা বিয়ের জন্য ধরেছেন। বিয়ে একটা করতেই হবে ছেলের। মেয়ে দেখলে দশ হাত দূর দিয়ে হাঁটত। আমরা ভেবেছিলাম বিয়ে করলে ঠিক হয়ে যাবে। তাই বিয়ের জন্য আমরাও চেষ্টা করেছি।
আমি মগ্ন হয়ে শুনি। বেশ চমকপ্রদ সংবাদই বটে।
লতিফ হেসে বলে–যা ভেবেছিলাম, বিয়ে করলেই সব ঠিক। তাই হল।
–তাই হল নাকি? আমিও হেসে জিজ্ঞেস করি।
–হল কিনা আপনি সবচেয়ে ভাল জানেন। দেখছেন না কেমন বউ পাগল ছেলে হয়েছে। আমি নিরুত্তর থাকি। লতিফকে বলতে পারি না আলতাফের প্রবলেমগলো। শাড়ির আঁচল পেতে থাকি আঙুলে। বাজে দুটো অভ্যেস আমার যায় না। নখ খোটা আর শাড়ির আঁচল আঙুলে পেচানো। আমার কষ্টগুলো এমনই, পৃথিবীর কাউকে বলা যায় না। বাবা মা জানতে চায়, আমি বলতে পারি না। লতিফকেও বোঝাতে পারি না কিছু, সংকোচে ভারি হয়ে থাকে আমার জিভ।
লতিফের সঙ্গে কথা বলছি, আলতাফ বাড়িতে ঢুকেই দেখে।
–আরে কী ব্যাপার তুই কখন এলি? উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর আলতাফের।
–অনেকক্ষণ। ভাবীর সঙ্গে গল্প করছিলাম।
–কী হীরা চা টা দাওনি লতিফকে?
–না। ঠিক আছে বস তোমরা, আমি দিচ্ছি।
নিজেই চা করে নিয়ে আসি। আলতাফ দেখে বলে–বাহ লতিফের অনারে আমার বউএর বানানো চা খেতে পারছি। লতিফ তুই প্রায়ই আসিস তো।
আলতাফ চায়ে চুমুক দেয় আর আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়। আলতাফের মধ্যে সেই ভয়ংকর রূপের লক্ষণই নেই। বিশ্বাস হতে চায় না এই লোকটিই কারও সঙ্গে আমার কথা বলা নিষেধ করে দিয়েছে। দেখে মনে হয় আমি যে লতিফকে এতক্ষণ সঙ্গ দিয়েছি, সে খুব কৃতজ্ঞ এতে।
–ভাবীকে নিয়ে আয় একদিন আমার বাড়িতে। ভাবী মনে হয় খুব বোর ফিল করেন। একা বসে থাকেন।
–ওর জন্য খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব বল, আমি তো সময় দিতেই পারি না। বেচারাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারি না।
আলতাফের কথায় আমার বিস্ময় বাড়ে। হয়েছে কী তার! যে লোক আজ সকালেই বলে গেছে আমার বাড়িতে বসে তুমি তোমার যা ইচ্ছে তা করতে পারো না। তোমার পছন্দ মত থাকতে চাইলে তুমি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে থাকো। তার হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন? আলতাফ কী তবে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। হতেও পারে, মানুষ তো আর সব সময় পশু থাকে না। পশুর স্বভাব মানুষের কাটেই একসময়। নাহলে সে আর মানুষ কেন!
লতিফ বলে-–মেয়ে দেখলে যে দৌড়ে পালাতি, ভাবীকে বললাম সে কথা।
আলতাফ হেসে বলে–পালাব না কেন? বিয়ে করে বউকেই ভালবাসব বলে তো সবাইকে এড়িয়ে চলেছি। হা হা হা।
আলতাফ এমন ভঙ্গি করে, যেন আমাকে সে ভালবাসে খুব।
–কী ভাবী, দড়ি একটু ঢিলে করুন। ও তো একেবারে ঘরকুনো ব্যাঙ হয়ে গেছে। আলতাফ হেসে বলে–বিয়ে করিস না। নিজের ভাল চাইলে বিয়ে করিস না। পুরুষ ছিলি, হয়ে যাবি আস্ত একটা গরু।
–ওরে ব্বাস। ওপথ তবে মাড়াচ্ছি না। হারে আলতাফ, বউ কি ক্রীতদাস বানিয়ে ছাড়ে?
–নির্ঘাত। আলতাফ হেসে বলে।
–ভাবী, ঠিক হচ্ছে না কিন্তু। পরে আমার বউও দেখে দেখে শিখবে। তখন উপায় কী হবে বলুন।
আলতাফ সিগারেট ধরায়। ধোয়া ছেড়ে বলে–বউ-এর কাছে হেরে যাওয়ায় আলাদা এক মজা আছে কিন্তু। আলতাফ মুচকি মুচকি হাসে। ও যদি আমার স্বামী না হত ধারণা করতাম ও স্ত্রীকে ভালবেসে বোধহয় মরেই যেতে পারে।