বাবা বলেন–জামাই যেভাবে বলে সেভাবে থাক। মুখে মুখে তর্ক করবি না। তোর দোষ কিন্তু কম না। তোর আশেপাশে দেখ বাঙালি বউঝিরা কী করে, তোর মা কী করেছে, তোর দাদী নানী কী করেছে। কারও স্বামীর সঙ্গে তো কারোর কোনও বিরোধ লাগেনি। তোর লাগে কেন, তোর যখন লাগে বুঝতে হবে তোর মধ্যে কোনও গোলমাল আছে।
–গোলমাল যা, তা ওর মধ্যে। আমার মধ্যে নেই।
–বাজে বকিস না। আলতাফ খুবই ভাল ছেলে। সবাই বলে।
–সবাই বললে তো হবে না। আমি যত জানি ওর সম্বন্ধে, তা তো আর কেউ জানে না।
–তোর তো মাথার ঠিক নেই এখন। পরে বুঝবি। আর রতন কেন আসে এই বাড়িতে?
–কেন আসে মানে? রতন আসলে অসুবিধা কী?
–আলতাফ যার আসা পছন্দ করে না তার আসার দরকার কী?
–কিন্তু কেন পছন্দ করবে না তা তো জানতে হবে। ধর তোমাদের আসাও যদি সে পছন্দ না করে তবে তোমরাও কি আর আসবে না? আর আমিও তা মেনে নেব?
–তুই বেশি কথা বলছিস হীরা। আমরা তোর চেয়ে বেশি বুঝি। দুনিয়াটা আমরা বেশি দেখেছি। যা বলছি তাই শোন। এখনও ভাল হয়ে চলার চেষ্টা কর।
–এর চেয়ে ভাল হতে আমি পারব না।
–নিজের কপাল নিজে নষ্ট করিস না। হীরা, আমার মেয়ে হয়ে তোর এই অধঃপতন, জামাই ডেকে এনে মেয়ে সম্পর্কে কমপ্লেইন করলে এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে! ছি ছি।
বাবা মা বিষণ্ণ মুখে চলে যান। আমি তাদের কোনও সান্ত্বনা বাক্য উপহার দিতে পারি না। আমি তাদের কথা দিতে পারি না এখন থেকে আমি ভাল হয়ে চলব। স্বামী শাশুড়ির কথা শুনব। আলতাফ বাবা মাকে কদমবুসি করে। বাবা মা আলতাফের মাথায় হাত বুলিয়ে বলনে–ভাল থেক বাবা। ওঁরা চলে যাবার পর আলতাফ বেশ গর্বিত গ্রীবা নিয়ে আমার গা ঘেঁষে চলাফেরা করে। সে তার প্রতি পদক্ষেপে বুঝিয়ে দেয় হি ইজ রাইট।
১০. বাড়ির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়
বাড়ির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় টেলিফোনে আমি হাত দিতে পারব না। ফোন তো আমি করতে পারবই না, রিং বাজলেও শাশুড়ি ধরবে। বাড়ির মেইন গেটে তালা দেওয়া হয়েছে। আমার চেনা কোনও লোক যেন আসতে না পারে। চাবি শাশুড়ির কাছে থাকবে। আলতাফের নতুন নিয়ম এটি। কিন্তু এই ব্যবস্থা তো আমার সহ্য হবার নয়। আমি কিছু করতে পারি না। অক্ষম আক্রোশে ছটফট করি।’
কারও কাছে যে আমার ফোন করা জরুরি তা নয়, কিন্তু আমি ইচ্ছে করলে ফোন করতে পারব না কেন? আমাকে কেন বাধা দেওয়া হবে। এর নাম বাধা নয়, অপমান, স্রেফ অপমান। আমি কী এমন তুচ্ছ মানুষ যে আমি একজন মানুষ, আর সে আমারই মত মানুষ, দিব্যি আমাকে অপমান করবে আর তা সহ্য করতে হবে আমাকে। আলতাফ কথায় কথায় বলেছিল আমি তার খাই পরি, তাই তার কথা আমাকে শুনতে হবে। কারও খেলে পরলে যদি তার অন্যায় গুলো বরণ করে নিতে হয় শরীরে মনে–তবে না হয় আমি না-ই খেলাম পরলাম তার। নিজের খাওয়া পরা জোটাতে খুব কি অসুবিধে হবে! না হয় একটু অসুবিধে হোক। যা ভোগ করছি, তা তো আর সব সুবিধে নয়। আমাকে যে সে খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে তার মূল্য কি আমাকে আমার সব ইচ্ছের মৃত্যু ঘটিয়ে দিতে হবে!
আমার এও মনে হয় আমি আসলে নিজেকেই অপমন করছি। আমাকে যদি আমি কারও দ্বারা অপমানিত হতে দিই, এর অর্থ নিজেকেই অপমান করা আমার। আলতাফের কোনও পরিবর্তন নেই জীবনে। সে যেমন ছিল তেমনই আছে। মাঝখান থেকে লাভ হয়েছে রাতে সে খেলা করবার জন্য আস্ত একটা শরীর পায়। আমি কী পাই! বাবার সংসারে খাওয়া পরা পেতাম, এ সংসারেও পাই। বাবার সংসারে শরীরে যন্ত্রণা হত না, এ সংসারে হয়। তাই বলে বাবার সংসারটি যে আমার জন্য খুব চমৎকার একটি জায়গা ছিল তা আমার মনে হয় না। কারণ ওই বাড়িতে আমাকে তৈরি করা হয়েছে এই বাড়ির জন্য। আর কিছুই করা হয়নি। আমি যেন ভাল বঁধতে পারি, ভাল সাজতে পারি, ভাল ঘর গুছোতে পারি এসবেরই ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। আমি যেন আমার স্বামীকে তুষ্ট করতে পারি, তৃপ্ত করতে পারি–আমি যেন নত হতে পারি, মুক্ত হতে পারি–তারই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আমিও না বুঝে শিখেছি। ভেবেছি এসবেই বোধহয় সত্যিকারের সুখ। কিন্তু কই সুখ তো আমি পাচ্ছি না। আমার কেবলই মনে হচ্ছে এ আসলে সুখের কোনও পথ নয়। সুখের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। স্বামী যদি সুখ দেয়, সুখ হবে, না দিলে হবে না–এই ব্যাপারটি আমাকে কিছুতেই স্বস্তি দেয় না। নিজেকে আমার জড় পদার্থ জাতীয় কিছু মনে হয়। আলতাফ আছে সুখে। স্বস্তিতে। যখন যা ইচ্ছে হচ্ছে করছে। খাচ্ছে দাচ্ছে চাকরি করছে ঘুমোচ্ছে আড্ডা দিচ্ছে। তাকে বাধা দেবার কেউ নেই। আমি তাকে বাধা দেবার ক্ষমতা রাখি না। কারণ আমার সে খায় না, আমার সে পরে না–সোজা হিসেব। এক খাওয়া পরার জন্য কত কিছু নির্ভর করছে, ভাবাই যায় না।
আচ্ছা এরকম কী হতে পারে না আমি নিজের খাওয়া পরবার ভার নিজেই নিলাম। হতে তো পারেই, হবে না কেন। মানুষ কী না পারে, সবই সম্ভব মানুষের জীবনে। ঘরের বন্দি জীবন ধীরে ধীরে আমার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছে। আমি একবার ভাবি, চুপিচুপি বেরিয়ে যাব, কেউ জানবে না কোথায় যাব, দূরে কোথাও গিয়ে কিছু একটা করব, জগতে কি কাজের অভাব! আবার ভাবি, এই যে মেয়েরা ‘হাউজ ওয়াইফ’ হয়ে বসে আছে, এরা তো বেশ সুখেই আছে মনে হয়। কারও কোনও অভিযোগ নেই। এরা কি আসলেই সুখে থাকে না কি ভান করে সুখী মানুষের!