.
রাতে শুতে চাই অন্য বিছানায়। আলতাফ মানে না। সে দাঁড়ায় এসে অন্য বিছানার সামনে। বলে-ওঠ। কণ্ঠে আদেশ তার। উঠতেই হবে। রক্তচক্ষু স্বামী দাঁড়িয়ে আছে পাশে, পঁড়িয়ে থাকুক। আমি বলি–আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।
–ঘুম পাক তবু ওঠ। বিয়ে করেছি আলাদা বিছানায় থাকবার জন্য নয়।
আলতাফ আমার হাত ধরে টেনে তোলে। নিয়ে যায় পাশের ঘরে। বিছানায়। পাতলা নাইটি পরা আমার। একটানে খুলে ফেলে। একসময়, বিয়ের পর কদিন, এই স্পর্শই কী ভীষণ আনন্দ দিত, সবটুকু হোক, কিছুটা হলেও তা দিত। অথচ আলতাফের সেই হাত, সেই হাতের স্পর্শই এক বিবমিষা জাগায় ভেতরে। আলতাফের গোঙানোকে লাগে যেন কাদা পেয়ে শুয়োর ঘোৎ ঘোৎ করছে। চুমু দিতে চায়। মুখ সরিয়ে নিই। আমি যে এই সব চাচ্ছি না, এসব যে আমার ভাল লাগে না–তা আমার শরীরের নির্লিপ্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিই তাকে।
সে তার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আমাকে পিষে ফেলতে চায়। মুখ থেকে ভুরভুর করে দুর্গন্ধ বের হয়। বিড়বিড় করে বলে–তোমার অডাসিটি দেখে আমি অবাক হই। কি না করেছি তোমার জন্য, বন্ধু বান্ধবের বাড়িতে আড্ডা, ঘোরাঘুরি, চায়নিজ খাওয়া, ভেবেছিলাম তোমাকে ব্যংকক সিঙ্গাপুরও নিয়ে যাব এমাসে। এত করি, আর
সে বলে আমার নাকি দোষ!
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি–তোমারই দোষ। আমি রুবিনা ভাবীর কাছে সব শুনেছি।
–মনজুরের বউ এসেছিল?
–হ্যাঁ, বলল মনজুর নাকি অনেকক্ষণ থাকে।
–মানে?
–মেয়েদেরও নাকি অরগাজম হয়।
–এসব কি ওই মহিলা শিখিয়ে দিয়ে গেছে?
আমি কথা বলি না। আলতাফের কথায় মনে হয় দোষ যেন তার নয়, দোষ রুবিনার। রুবিনার দোষেই আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। আলতাফ ঝট করে উঠে যায় বিছানা থেকে। আড়চোখে লক্ষ্য করি প্রচণ্ড অস্থিরতা তার মধ্যে। বাথরুমে ঢুকে সে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। মাথা ধোয়, মাথায় পানি ঢাললে মন নাকি শান্ত হয়, তাই। আলতাফ মন শান্ত করছে। মেয়েদের যে অরগাজম হয় তা যেন আলতাফ প্রথম জানল। আলতাফের কি হয় ওইসব রুবিনা যা বলেছিল? কী জানি বুঝিও না। ও বলেও না কিছু। আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে ব্যাপারগুলো। অষ্পষ্ট ঠেকে সব। যেন কী একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে স্বামী-স্ত্রীতে। বড় রহস্যময় সব। এ যদি কোনও দেওয়াল হয় আমি ভেদ করতে পারিনি। আমার কাছে সবই দুর্বোধ্য লাগে। নাগাল পেতে চাই, দূরের লাগে সব। আলতাফের কাছে বুঝতে চাই। এমনও হয়েছে আমি তাকে বলেছি তোমাকে আমি দেখতে চাই পুরোটা।
–মানে? কি দেখবে?
–তোমার শরীর। আমি সামান্য লজ্জিত না হয়েই বলি।
–আমার শরীরে দেখার কী আছে?
–আছে।
আলতাফ রাগ হয় আমার কথায়। বলে রুবিনারই কাজ এসব বুঝি। ও তোমাকে উল্টোপাল্টা কী সব বুঝিয়েছে। বাজে মেয়েলোক।
–স্বামীর শরীর আমি দেখব না? বউরা কি দেখে না?
–তুমি কী ইঙ্গিত করছু আমি কি বুঝি না?
–হ্যাঁ বোঝ। আজকাল একটু বেশিই বোঝ তুমি।
আলতাফ লুঙ্গিখানা কষে পড়ে। সিগারেট ধরায়। ঘন ঘন ফোঁকে। ঘর ধোয়ায় ভরে যায়। এয়ার কুলার চলে ঘরে, এর মধ্যেই ঘাম ঝরে আলতাফের। ভনভন করে একটি মাছি ঘোরে। রাতে মাছি আসে কোত্থেকে! কানের কাছে মাছিটি ভন ভন করতেই থাকে। আমি কোথায় তাড়াব তাকে। এই ঘরের ভেতরই সে ঘুরবে। ভনভন করে ঘুরবে।
আলতাফকে দেখতে চাইলাম। চাইতেই পারি। ওর এত ক্ষেপে উঠবার কারণ কী। নাকি লজ্জা পেয়েছে। নাকি ভয়! একটির পর একটি সিগারেট সে পুড়তে থাকে। আমার পক্ষ থেকে কী করলে আলতাফ খুশি হবে জানি না। আর ওকে খুশি করবার সব দায়িত্ব আমারই বা কেন? আমি তো এমনও ভাবতে পারি আমি যা চাই তার কতটুকু পালন করছে আলতাফ! একটি প্রশ্নও মনে উঁকি দেয়। আলতাফ কেন এমন রিয়েক্ট করল। তার সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখবার অধিকার কি আমার নেই? আমার গুলো সবই সে দেখছে, দলছে, পিষছে; তবে?
আলতাফকে ঠিক আমি বুঝতে পারি না। সেদিন সারারাত সে আর ঘুমোল না। তাকে দেখাতে বলেছিলাম, দেখাল না। যোজন দূরত্ব নিয়ে শুয়ে থাকল। বুঝি না, দেখালে কী ক্ষতি হত ওর। ও তো পঙ্গু নয়, স্ত্রীর আবেগের সামান্য মূল্য ও দিল না। আমার কেমন সন্দেহ হয়। আলতাফের কোনও শারীরিক ত্রুটি আছে কি? আমার দুশ্চিন্তা ঘোচে না। কিন্তু একটি ব্যাপার বুঝি, আলতাফ আমাকে যেন কিছু লুকোয়। একদিন হঠাৎ বাথরুমে ঢুকেই দেখি আলতাফ কিছু একটা লুকোচ্ছে, শিশি টিশি জাতীয়। বললাম কী হাতে তোমার? বলল ও কিছু না এমনি। কিছু না হবে কেন? স্পষ্ট দেখলাম কিছু। আমাকে লুকিয়ে আলতাফ ওই শিশি গুলো নিয়ে কিছু করে এরকম মনে হয়েছিল আমার। তারপর লক্ষ্য করতাম শোবার আগে বাথরুমে ও অনেকক্ষণ সময় ব্যয় করে। জিজ্ঞেসও করেছি কত, কী কর অতক্ষণ ওখানে? আলতাফ মুখ গম্ভীর করে বলে কী করি তা দেখাতে এখন তোমাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকতে হবে। তাই না?
আলতাফকে আমার সন্দেহ হয়। সে কেন ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। সে কেন আমাকেও দেখাতে চায় না শরীর? তার কি কোনও প্রব্লেম শরীরে? আমার দুশ্চিন্তা ঘোচে না। ওর যা কিছু, আমি কেন জানব না সব? আমি তো একটু একটু করে আমার আনন্দ বেদনা সবই জানিয়েছি তাকে। আমি যদি অবাধে উমুক্ত হতে পারি, তার বেলায় বাধা কেন?
০৬. ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত
ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। আলতাফ অফিসে চলে যাবার পর সিদ্ধান্ত নিই আলতাফ যখন যাবে না, নিজেই যাব। রুবিনার বাড়িতে ফোন করে ডাক্তারের ঠিকানা পাওয়া যায়। নয়াপল্টনে বসেন, সকালে দেখানো যায়। নয়াপল্টনে সেই ডাক্তারের চেম্বার খুঁজে বের করি। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। ডাক্তারের দেখা মেলে। ভয় ভয় লাগে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন রোগী কে। রোগী যে ঠিক কে আমি বোঝাতে পারি না। বুড়ো মত ডাক্তার ভদ্রলোক ছাড়াও রুমে আরও লোক ছিল। বেশ লজ্জা করছিল বলতে কার অসুখ কী অসুখ। সাহস করে একা একা ডাক্তার পর্যন্ত চলে এসেছি বটে কিন্তু কী কথায় বা কী ভাষায় যে এসব বলা যায় আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ওঁরাই আমাকে প্রশ্ন করলেন আমি ম্যারেড কি না। ম্যারেড জানবার পর প্রশ্ন স্বামী কোথায় স্বামী আসেনি কেন আসেনি এধরনের আরও প্রশ্নের জবাব দেবার পর আমার সমস্যা কি জানতে চাইলেন ডাক্তারের এসিসটেন্ট। কয়েকজোড়া কান সজাগ আমার সমস্যা শুনবার জন্য। অপ্রস্তুত বোধ করলাম। এত ব্যক্তিগত সমস্যা কি একঘর মানুষের সামনে হড়হড় করে বলে ফেলা যায়। ঢোক গিলে গিলে টেবিলের কোণা নখে খুঁটে খুঁটে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে যা বললাম তা হল রাতে স্বামীর সঙ্গে যা হয় তা আমার ভাল লাগে না। কেন ভাল লাগে না? ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন। বলতে সংকোচ হয় আবার রুবিনা ভাবীর কথাও মনে হয়, তিনি বলে দিয়েছেন ডাক্তারের কাছে কিন্তু লজ্জা শরম ভেঙে সব বলবেন; তাই খানিক থেমে, খানিক কেশে আমি বলি–আমি কোনও সুখ টুখ পাই না?