নূপুর ফোন রেখে দেয়। তার ভয় হতে থাকে। নাইম হেন কিছু নেই যে না করতে পারে। নূপুরের ইচ্ছে করে পালাতে। নাইম যে শ্বাস ফেলছে, সেই শ্বাসে আগুন, পুড়ে ছাই করে দিতে পারে। নিজেকেই বলে সে বারবার, পরিবারের লোক হলেই পরিবারেরর কারও মৃত্যুর খবর তাকে জানতে হবে, এর পেছনে কোনো যুক্তি নেই।
নিজেকে বাঁচাতে নূপুর দেশ থেকে চুপিচুপি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কাউকে জানায় না সে কবে যাচ্ছে , কখন যাচ্ছে। ঢাকায় শুধু নাইমের নয়, নূপুরেরর কাকার, মামার, কাকাতো-মামাতো – খালাতো ভাই বোনদের বাড়ি। কারও বাড়িতে সে ওঠে না। কবে মারা গেছে যমুনা, কেন মারা গেছে, দেশ ছেড়েছিল কেন, বিয়ে না করেই তো বাচ্চা নিয়েছিল, বাচ্চার বাবা কে ছিল—এসব প্রশ্ন করে নূপুরের মুখের দিকে সব আত্মীয়রাই যে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে, নূপুর বেশ জানে। অনেকদিন বিদেশে বাস করেছে সে, তাই বলে দেশের কৌতূহল যে কী রকম মাত্রা ছাড়া তা এখনও ভুলে যায়নি।
নূপুরের পাসপোর্ট আমেরিকার। ভারতের ভিসা পেতে খুব দেরি হয়নি, ভিসার লম্বা লাইনে অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে অনেকক্ষণ। একা একাই করেছে সব। কারও সাহায্য সে চায়নি। বেশ কয়েক বছর হল নূপুর কোনও কিছুতেই কারও সাহায্য আর চায় না।
যেদিন যাচ্ছে নূপুর, সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে সে। কপালের সামনে ক’টা পাকা চুল। দু’আঙুলে হেঁচকা টান দিয়ে পাকা চুল এক এক করে তুলতে থাকে নূপুর। নূপুরের চুল পেকেছে দেখলে যমুনার নিশ্চয়ই মনে হবে খুব বুড়ো হয়ে গেছে নূপুর। চিরকালই ছোটবোনকে সেই ছোটবেলার ছোটববোনই মনে হয়। ছোটবোনদেরও যে বয়স বেড়ে পঞ্চাশ পেরোতে থাকে, অনেকসময় ঠিক বিশ্বাস হয় না। নূপুর ভালো একটা শাড়ি পরলো, যমুনা যেরকম শাড়ি পছন্দ করে। সাজলো অনেকক্ষণ ধরে। ঠোঁটে লিপস্টিক পরলো, কপালে একটা লাল টিপ পরলো। চোখে কাজল, ভ্রু আঁকলো। মুখে মাখলো ময়ইশ্চারাজার, ফাউণ্ডেশন, পাউডার। পারফিউম মাখলো সারা শরীরে। আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে যখন দেখে নিজেকে, নূপুরের চোখ দিয়ে নয়, দেখে যমুনার চোখ দিয়ে। নিশ্চয়ই নূপুরকে দেখে খুশি হবে যমুনা। নিশ্চয়ই হাসবে সেই অসাধারণ হাসি। হঠাৎ নূপুর চমকে ওঠে। এ কী ভাবছে সে। এ কেন ভাবছে সে। কী ভেবে এতক্ষণ ধরে সে সাজলো। যমুনা তো্ নেই! একটা আর্তচিৎকার তার কণ্ঠ চিরে বেরোতে থাকে। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে নূপুর। উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
হোটেলের রুমে ফোন বাজে, নিচে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। বিমান বন্দরে যাওয়ার ট্যাক্সি।
যমুনা মারা যাওয়ার তিনদিন পর নূপুর বাংলাদেশ বিমানে আধ ঘণ্টার উড়ান দূরত্বে পৌঁছোলো কলকাতায়। দমদম বন্দরে দাঁড়িয়ে ছিল নির্মলা। নির্মলাকে চিনতে নূপুরের কোনও অসুবিধে হয় না।