কণ্ঠস্বর শান্ত, দুজনেরই। রাত দশটার শুরু হয়, কথা রাত দেড়টায় শেষ হয়। দুজনই শুয়ে, দু’ দেশে। কথা হয় একজনকে নিয়ে, যে নেই। যে মৃত, সে বেঁচে থাকা মানুষকে ঘনিষ্ঠ করতে থাকে, নিজের লোক করে যেতে থাকে। যে মৃত সে-ই যেন জীবিত সত্যিকার। আর যারা তাকে ভালোবাসছে, তারাই শোকে মুহ্যমান, তারাই মৃতবৎ, তারাই মৃত।
নির্মলার কাছে যমুনার জীবন যাপনের কথা শুনতে শুনতে নূপুরের মনে হয় অনেকগুলো বছরের দূরত্বকে ভেঙে চুরে, দু ‘দেশের মাঝখানের কাঁটাতারকে ছিঁড়ে ছুঁড়ে যমুনা বাতাসের চেয়েও বেগে, আলোর চেয়েও দ্রুত, সব ছাপিয়ে, সব মাড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় বুঝি যমুনা এই বাড়িতেই আছে, এই বাড়িতে যেন দু’বোন শৈশব আর কৈশোরের সেই দুরন্ত দিনগুলো আর বছরগুলো কাটাচ্ছে। যমুনা যেমন কাছে ছিল, সারাক্ষণ কাছে ছিল, তেমনই কাছে আছে, সেই আগের মতো আছে। যেন তাকেই নূপুর শুনছে এখন, যেমন শুনতো। যমুনাময় জীবন ছিল নূপুরের। জন্ম হওয়ার পর যমুনাকে দেখেছে, যমুনার কাছেই নিজের শৈশব কৈশোর যৌবনে শিখেছে অনেককিছু, হয়তো সবকিছুই। হয়তো সব শিক্ষাই জীবনে প্রয়োগ করতে পারেনি, তাতে কী, ভেতরে সুপ্ত অবস্থায় আছে, এখনও আছে, নূপুরের বিশ্বাস আছে, কেবল নাড়া পড়লেই ভেতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়বে যুদ্ধের সৈনিকের মত। শুধু তো যমুনাই ছিল না, আত্মীয় স্বজন ছিল, কিন্তু যমুনা যেভাবে ছিল, সেভাবে নূপুরের জীবনে কেউ ছিল না। যমুনা আবিস্কার করতো, নতুন কথা বলতো, নূপুর গ্রহণ করতো। সবসময় হয়তো গ্রহণ করতো না, তর্ক করতো কিন্তু ভেতরে ভেতরে মানতে তাকে হতই যে যমুনা যা কিছুই বলে, তা-ই নূপুরকে ভাবায়। নূপুর ফেলে দেয় অনেক কথা ছুঁড়ে, কিন্তু খুব বেশিদূর ছুঁড়তে পারে না। এক সময় কুড়িয়ে আনতে হয়, কুড়িয়ে এনে নিরালায় বসে নাড়তে হয় ভাবনাগুলো।
দিনগুলো যেন হাতের মুঠোয়। সেই দিনগুলো। একসঙ্গে বড় হওয়ার দিনগুলো। যমুনা কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই সেই দিনগুলোর কথাই বলতো। দেখে মনে হত কী একটা ঘোরের মধ্যে আছে, বলতো, ‘জীবনে পারলে যে করেই হোক ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের ওই বাড়িতে আমি যাবোই। আগের মতো আবার সেই বাবা মা, আবার সেই ইনোসেণ্ট দাদা আর বোকা বোকা নূপুরকে ওই বাড়িতে আমার চাই’। নূপুর বলেছে, ‘যা গেছে তা গেছে। অতীত নিয়ে এভাবে পড়ে থেকো না। দাদাও আর ইনোসেন্ট নেই, আমিও আর বোকা নই’। যমুনা হেসে বলেছে, আসলে ‘সুখের স্মৃতি বলতে আমার ওইটুকুই। স্মৃতির জাবর কেটে কেটে স্মৃতিকে বাঁচাই’।
যমুনার কথা বলতে বলতে কেঁদেছে নির্মলা। নূপুর কাঁদেনি। অনুভব করেছে বড় একটা পাথরের তলায় চাপা পড়েছে সে। বুকের ওপর বড় একটা পাথর, চাইলেই যে পাথরকে ঠেলে সরানো যায় না।
পরদিন ঢাকায় নূপুর একটা হোটেলে উঠেছিল, নাইমের বাড়িতে ওঠেনি। নাইমকে জানায়নি যে সে ঢাকায়। ইচ্ছে করেনি জানাতে। শেষ যা কথা যা হয়েছে দুজনের, তার পর নাইমের মুখোমুখি হওয়াটা, নূপুরের মনে হয়নি, উচিত।
–শোন, আমিই যাবো। তুই অফিসিয়াল ব্যাপার গুলো পারবি না। ওর অ্যড্রেসটা বল।
–অফিসিয়াল ব্যাপার মানে?
–ডেথ সার্টিফিকেট বার করা। ব্যাংকের টাকা পয়সাগুলো ট্রান্সফার করা। বাড়ি টাড়ি যা আছে বিক্রি করা। জিনিসপত্র গুলো সর্ট আউট করা। বডি মেডিকেলে দেওয়া, নানারকম কাজ। এসব পারবি না। ওখানে লোকেরা লুটে খাবে ওর সব কিছু।
–আমি পারবো। তোমার অত চিন্তা করার দরকার নেই। ওখানে লোক আছে আমাকে হেল্প করার।
–ভাব দেখাচ্ছিস যমুনার ওপর অধিকার একার তোর। তা কিন্তু নয়। যমুনার সহায় সম্পত্তি টাকা পয়সার ভাগ আইনত আমি পাবো। আমি ভাই। ভাইরা পায়। বোনরা পায় না। ওর অ্যাড্রেস দে।
–ভুলে যেও না ওর একটা মেয়ে আছে। যা পাবে ওর মেয়ে পাবে। আর বুবু যদি উইল করে গিয়ে থাকে তাহলে আর কথাই নেই। এ দেশে উইল না চললেও ভারতে তো উইল চলে। বাবার সবকিছু নিয়েছো। বুবুর টাকা পয়সায় দয়া করে লোভ করো না। ওর মেয়েকে কিছু পেতে দাও। তোমার লোভের কারণে নিজের বাপের সম্পত্তি আমরা দুবোন পেলাম না। এখন তপুকেও বঞ্চিত করোনা। তোমরা পুরুষেরা অনেক কায়দা কানুন জানো, বুবুর যদি কিছু থাকে, জানি না আদৌ কিছু ছিল কি না, নাকি ধার করে চলতো, তুমি সব আত্মসাৎ করতে পারবে, তোমার সেই ক্ষমতা আছে। কিন্তু দয়া করে এবার নিস্তার দাও। লেট হার রেস্ট ইন পিস।
–ওর পিস তো আমি নষ্ট করছি না। যত ইচ্ছে পিস ও ভোগ করুক। কিন্তু আইনের তো ব্যাপার আছে। তুই লিগা্লি আমার বোনের হোয়ারঅ্যাবাউটস জানার আমার যে রাইটস, তা ভায়োলেট করতে পারিস না। আজকে সে ডেড। আমার এখন দায়িত্ব তার কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এটা ভাই হিসেবে আমার ডিউটি। ওর মেয়ে ইন্ডিয়ায় নেই। সুতরাং সৎকার টৎকার যা করতে হবে, আমাকেই করতে হবে।
–সরি। বুবু বলে গেছে, লিখে গেছে। বডি থেকে যে যে অরগান তুলে নেওয়ার সেগুলোও নেওয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু গিয়ে বডিটা মেডিকেলে দিয়ে আসতে হবে। সেটা করার জন্যই যাবো। একবার শুধু সেই মুখটা হাতটা ছোয়াঁ।
নূপুরের কণ্ঠস্বর তখন মেঘলা হয়ে আসে।
–সেটা করতে তোর একার যেতে হবে কেন। আমি সঙ্গে যাবো। আর তুই যদি একা যাস, তোর নিশ্চয়ই অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে।
–যত যাই বলো না কেন দাদা, আমি তোমাকে সঙ্গে নেবো না।
–আমার দু’মিনিট লাগবে যমুনার অ্যাড্রেস বার করতে। কলকাতা শহরে কি আমার লোক নেই ভেবেছিস? যমুনা কোথায় থাকতো কী করতো, ভেবেছিস এসব আমার কানে আসেনি? কিছুই বলিনি তোদের। সব জানি। ওখানে তার সব রকম কার্য কলাপের কাহিনী আমার জানা। দু’মিনিট লাগবে।
–ভালো কথা। দু’মিনিটে তুমি ওর ঠিকানা বার করে ওর বাড়িতে যাও। তোমার বোন মরে পড়ে রয়েছে। যাও তার ধন সম্পদ টাকা পয়সা যা আছে নিয়ে এসো। তোমার কাজে লাগবে। আমি যদি যাই আমি যাবো বুবুকে একটু চোখের দেখা দেখতে। শেষ দেখাটা দেখতে। মেডিকেলের কাটা ছেঁড়া হওয়ার আগে।