–অর্ধেকের বেশি চুল পেকে গিয়েছিল। আমার চোখের সামনেই পাকলো। এভাবে উৎসব করে কারও চুল পাকতে দেখিনি। গ্রে হেয়ারে কিন্তু অসাধারণ লাগতো।
–ডাই করতো?
–ডাই করবে যমুনা? পাগল হয়েছো? কয়েকদিন বলেছি চুলে কিছু রং টং লাগাও। গোদরেজের ভালো রং এসেছে। নাহ, লাগাবেই না। বয়স বেড়েছে বা বাড়ছে এ নিয়ে কোনওদিন কোনও দুশ্চিন্তা করেনি। ওরকমই ছিল যমুনা। আমাদের কিছু বন্ধু তো ওকে ওয়ার্কোহোলিক বলে। এত ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসতো!
— কী নিয়ে ব্যস্ত থাকতো ইদানিং?
— চাকরিটা তো করতোই..
— চাকরি!
–কেন, অগ্নি পাওয়ার এণ্ড ইলেকট্রনিক্সে সোলার এনার্জির চিফ ফিজিসিস্ট ছিল। নিশ্চয়ই জানো।
–ও হ্যাঁ তা তো জানি..
–এই ব্যস্ততার মধ্যেই গড়ে তুলেছে সিস্টারহুড, সেও তো বলেছি। এখন তো বেশ বড়ই হয়েছে সিস্টারহুড। প্রায় পাঁচহাজার সদস্য।
— তোমার কথা কিছু না জানালেও সিস্টারহুডের কথা বুবু জানিয়েছিল আমাকে। একদিন এও বলেছিল, চাকরি ছেড়ে দিয়ে ওই সিস্টারহুডেই নাকি সময়টা দেবে। এই রিস্কি সিদ্ধান্ত বুবুই নিতে পারে। ভাগ্যিস শেষ অবদি ছাড়েনি। ভালো একটা চাকরি ছেড়ে দিলে পরে কী হয় না হয় তা কে জানে। মানুষের বিপদের কথা কি বলা যায়! শুধু কি চাকরি আর সিস্টারহুড! তপুকে মানুষ করেছে।
নির্মলা হেসে বলে, তপুর পেছনে যমুনাকে মোটেই ব্যস্ত থাকতে হয়নি বললেই চলে। তপুটা এমনি এমনি বড় হয়ে গেল। যমুনা তো ওকে একেবারেই বাঙালি মায়েদের মতো বড় করেনি। ভালো ইস্কুলে পড়েছে, এই টুকুই। ঘরে মাস্টার টাস্টার রেখে দেয়নি। পড়া বুঝতে না পারলে যমুনাকে জিজ্ঞেস করতো।
–মাস্টার টাস্টার রেখে দেয়নি, এর মানে এই নয় যে তপুকে ভালোবাসতো না। ভীষণ ভালোবাসতো। কিন্তু বাইরের কেউ সহজে বুঝতো না। আসলে যমুনা তো তপুকে নানারকম খাবার খাইয়ে বা জিনিসপত্র কিনে দিয়ে বোঝাতে চাইতো না যে সে তপুকে ভালোবাসে।
–এটা কিনে দাও ওটা চাই ওসবও করতো না তপু। আবদার করা, বায়না করা –এই ব্যপারগুলো তপু শেখেইনি। একেবারেই না। বইএর পোকা। বই কিনে দিলেই খুশি।
–আমার ছেলেটাকে বই কিনে দিতাম, ও ছুঁয়েও দেখতো না। বুবুটা খুব লাকি ছিল।
–যমুনা বলতো তুমি ওকে বুবু বলে ডাকতে। বুবু ডাকটা আমারও খুব পছন্দ।
–আসলে বুবু তো কোনও নাম নয়, বুবু হল দিদি।
নির্মলা হাসতে হাসতে বলে, জানি।
এভাবে কথা গড়াগড়ি খেতে থাকে। কী পোশাক পরতো যমুনা, শাড়ি ছাড়া আর কি কিছুই পড়তো না! নীল রংটা ভালোবাসতো খুব এককালে! শেষদিকেও কি নীল রংই ছিল? বিদেশে তো বিদেশি পোশাক পরতো। কী খেতো? সব খেতো। নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষাও করতো খাবার নিয়ে। সে কী আর শুধু খাবার নিয়ে। পোকা মাকড় নিয়েও, ইট পাথর নিয়েও। সে কী আর আজ থেকে! কে রাঁধতো? কে আবার, বেশির ভাগ নির্মলাই। নির্মলাকে যমুনা কখনও আবদার বা অনুরোধ বা আদেশ করেনি ঘর সংসার আর রান্না বান্না সামলাতে, নির্মলা যা করেছে ভালোবেসেই করেছে। অবসরে কী করতো, অবসর বলে সত্যি কি কিছু ছিল? হ্যাঁ ছিল, নিশ্চয়ই ছিল। বই পড়তো। বেড়াতো। তবে বই পড়া আর বেড়ানোকে যমুনা খুব জরুরি কাজ বলেই মনে করতো। এ দুটোর কোনও একটিকেও এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে নেয়নি। যেন শিখছে এসব থেকে। বই পড়তো লাল কালিতে দাগিয়ে দাগিয়ে, মার্জিনে লিখতো নানা কিছু। আর বেড়াতে গেলেও হাতে একটা নোটবই থাকতো, নতুন জায়গায় নতুন কী দেখলো, নতুন কোনও লোকের সঙ্গে নতুন কী কথা হল, নতুন কী খেলো, নতুন কী শুনলো, এসবের অনেক কিছু লিখে রাখতো, আবার হঠাৎ হঠাৎ নিজের কিছু একটা মনে হলে, যে কোনও কিছু নিয়েই, লিখতো। নির্মলা বলতো, মাথাই তো আছে মনে রাখার, কাগজে লেখার দরকার কী! যমুনা হেসে বলতো, মাথাকে অত বিশ্বাস করতে নেই, কখন আবার সব গুলিয়ে ফেলে বা ভুলিয়ে ফেলে, বলা যায় না। কাউকে কি বিশ্বাস করতো যমুনা, মানুষ কাউকে, নূপুর প্রশ্ন করে। নির্মলা বলে, করতো, অনেককেই করতো, যেমন নির্মলাকে করতো, ভীষণ বিশ্বাস করতো। নূপুর আর জিজ্ঞেস করেনি নূপুরকে করতো কি না বিশ্বাস।
কারা বন্ধু ছিল, মুন আর গার্গী যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নূপুরের, কেমন আছে ওরা। নির্মলা ধীরে ধীরে নূপুরের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। যমুনার চেনা পরিচিতর সংখ্যা অসংখ্য। কিন্তু অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করায় খুব আগ্রহী কখনও নয়। বাড়িতে যে হৈচৈ আড্ডা হত না, তা নয়। বেশির ভাগই হত নির্মলার কারণে। নির্মলার ওপর যমুনা ভীষণ নির্ভর করতো। নির্মলা ডাকবে বন্ধুদের, আপ্যায়ণ করবে। নিজে কি যমুনা কিছুটা অন্তর্মুখী ছিল! না নির্মলার তাও মনে হয় না। তবে আড্ডা মানেই, যমুনা মনে করতো না, মন ভরে কারও নিন্দা করা অথবা কারও গুণকীর্তণ করা আর কিছুক্ষণ পরপরই কথা নেই বার্তা নেই গান গেয়ে ওঠা। নূপুর এত দেখেছে যমুনাকে, তারপরও নির্মলার চোখে আবার নতুন করে দেখে। এত চেনে সে তাকে, তারপরও নির্মলার মতো করে আবার চেনে। নূপুরের ভালো লাগে শুনতে যে যমুনা যে কোনও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওযাতে পারতো ভীষণ, সোলার সায়েনটিস্টদের সঙ্গে কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করাকে যে রকম গুরুত্ব দিত, সিস্টারহুডের অল্প শিক্ষিত মেয়েদের সঙ্গেও আলোচনা করাকে একই রকম গুরুত্ব দিত। তপুর পেছনে খরচ তেমন হয়নি বলে সিস্টারহুড চালানো সম্ভব হয়েছে। প্রথম প্রথম যমুনাকে প্রচুর টাকা ঢালতে হত, সদস্যদের চাঁদায় কুলোতো না। এখন সিস্টারহুড নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। নির্মলার ঠিক যেন এরকমই একটা সংগঠনের দরকার ছিল। আর দরকার ছিল যমুনার মতো একজন পথ প্রদর্শকের বা বন্ধুর। শুনতে শুনতে নূপুর ভাবে এ যমুনা নতুন কেউ, অচেনা কেউ, তার এতকালের চেনা দিদি নয় বা বুবু নয়।