যমুনা খুনী হোক আর যাই হোক, নূপুরের বোন যমুনা। দায়িত্ব তাকে এখন নিতেই হবে। কলকাতায় যার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তার নাম ফোন নম্বর সব তপুর কাছ থেকে নেয়। নির্মলা বসু। যমুনার বাড়িতে থাকছে বহু বছর। কেন থাকছে, ভাড়া থাকছে, নাকি কেয়ার টেকার, নাকি বাড়ির কাজে সাহায্য করার জন্য, নাকি বাড়ির খরচ শেয়ার করার জন্য একজন হাউজমেট, নূপুর আর তপুকে জিজ্ঞেস করে না। নির্মলাকে ফোন করে নূপুর জেনে নেয় কতদিন সে চেনে যমুনাকে, কী করে পরিচয়, যমুনার বাড়িটা ঠিক কোথায়, যেখানে যমুনাকে রাখা হয়েছে, সেটাই বা কতদূর বাড়ি থেকে। নূপুর যাক, এ নির্মলা চাইছে, নির্মলা জানিয়ে দেয়, কলকাতায় আর যারা আছে যমুনার চেনা পরিচিত বন্ধু শুভাকাংখী, সবাই চাইছে।
নির্মলার সঙ্গে যমুনার পরিচয় কলকাতায়। যমুনা বাড়ি খুঁজছিল কেনার জন্য। বিজ্ঞাপন দেখে অনেক বাড়িই দেখে এসেছে, পছন্দ হয়নি। যে বাড়িটি পছন্দ হল, সে বাড়ি নির্মলারই কাকার বাড়ি। নির্মলা তার বয়স হয়ে যাওয়া সন্তানহীন কাকা কাকীমার বাড়িতে থেকে কলেজে পড়েছে। বোলপুরের গ্রামে থাকতো বাবা মা। কথা ছিল, তার কাকা কাকীমাই তাকে কলেজে পড়াকালীন সময়ে একটা পাত্র জুটিয়ে বিয়ে দেবে। পাত্রও জোটেনি, বিয়েও হয়নি। ওদিকে গ্রামে বাবা মা দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে। কাকা কাকীমা একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন, এত বড় বাড়িতে বাস করার কোনো মানে হয়না, তারচে’ বাড়ি বিক্রি করে শহরে অনেক ফ্ল্যাট হচ্ছে, একটি কিনে নেবেন, ফ্ল্যাটও হবে, হাতে কিছু টাকাও রইবে জমা করে রাখার জন্য। বাড়িটা কিনেছিল যমুনা। আর ওই বাড়ি কেনা বেচার কারণে ঘন ঘন দেখা হতে থাকে, ঘন ঘন কথাও হতে থাকে নির্মলা আর যমুনার। যত কথা হয় তত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। যত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, তত ভালোলাগা বাড়ে, বন্ধুত্ব বাড়ে। কাকার ফ্ল্যাটে যাওয়ার আগে যমুনার কিছু আসবাবপত্র কেনায় আর বাড়ি ঘর সাজানোয় সাহায্য করার জন্য নির্মলা রয়ে গেল বাড়িতে। সেই যে রয়ে গেল, আর তার যাওয়া হয়নি কোথাও, না কাকার ফ্ল্যাটে, না গ্রামে, বাপের বাড়ি। নির্মলার বয়স বিয়ের বাজারের নিয়মে বেজায় বেড়ে গেছে বলে বিয়ের দুশ্চিন্তাও ততদিনে সবাই ত্যাগ করেছে। কাকার সংসারটা যতনা নিজের সংসার ছিল, তার চেয়েও যেন যমুনার সংসার নির্মলার নিজের সংসার হয়ে উঠলো। নির্মলার বিশ্বাস পুরুষ-নারীর সংসারের চেয়ে দুটো নারীর সংসার অনেক বেশি ঝুটঝামেলাহীন।
নির্মলা একটা ইস্কুলে মাস্টারি করতো, ইস্কুলের প্রিন্সিপাল নির্মলাকে এত যৌন হেনস্থা করতো যে শেষ অবদি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার। ওই বসে থাকা নির্মলাকে দেখতে দেখতেই যমুনা ভেবেছিল নির্মলা তো অন্য কোনও ইস্কুলে পড়াতে পারে, অন্যের ইস্কুলে না হলেও নিজের ইস্কুলে। সিস্টারহুড নামে প্রথমে একটা ইস্কুল শুরু করার কথা ভাবতে ভাবতে একটা সংগঠনের কথা ভাবে যমুনা। যেই ভাবা সেই কাজ। নির্মলার ওপরই দায়িত্ব বেশি পড়েছে। ঘুরে ঘুরে নির্মলাই সদস্য যোগাড় করেছে। টাকা পয়সা, নতুন চিন্তা, নতুন প্ল্যান বেশি গেছে যমুনার কাছ থেকে।
নূপুর শোনে আর ভাবে যমুনা তাকে কেন বলেনি নির্মলার কথা। এত দীর্ঘ বছর নির্মলা বাস করছে যমুনার বাড়িতে, আর যমুনা এত কথা বলেছে নূপুরকে, নির্মলার কথা কোনও কথা প্রসঙ্গেও বলেনি। নূপুর ভাবতো যমুনা বুঝি তাকে সব বলে। যমুনা কোনোদিন তো কিছু লুকোয়নি! একটু অভিমান হয় নূপুরের। পরক্ষণেই ভাবে কার ওপর আজ অভিমান করছে নূপুর! নূপুরই কি কোনওদিন যমুনার বাড়িঘরের কথা জিজ্ঞেস করেছে, ক’দিনই বা জানতে চেয়েছে যমুনা কেমন আছে, কেবল তো নিজের কথাই বলেছে, নিজের নানারকম সমস্যার কথা, আর যমুনাও খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চেয়েছে কেবল নূপুরেরই কথা। যদি হঠাৎ কখনও কিছু নূপুর জানতে চেয়েছে, সে তপু কেমন আছে, তা।
নূপুরের অনেকবার মনে হয়েছে তপুর মতো বলে দেবে, ‘তোমরা যা ইচ্ছে করার করো, আমি ওর মৃত মুখ দেখতে পারবো না। ও আমার কাছে জীবিত। আমি চাই ও জীবিতই থাকুক স্মৃতিতে’।
ভাবতে ভাবতে একবার বলেওছে নূপুর নির্মলাকে, ‘আপনারাই তো অনেক বছর ধরে যমুনাদির কাছে ছিলেন। আমরা আত্মীয় হতে পারি, কিন্তু দূরে্ই ছিলাম, হয়তো অনেকটা বাধ্য হয়েও দূরে থাকতে হয়েছে। মাঝখানে অনেকগুলো বছরই চলে গেছে। যোগাযোগ আর কারও সঙ্গে না থাকলেও আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে..’
–আপনার কথা খুব বলতো।
নির্মলা বলে।
–বলতো বুঝি?
–হ্যাঁ, খুব বলতো।
— কী বলতো?’
–কত কিছু বলতো। ছোটবেলায় কোথায় কেমন করে আপনারা বড় হয়েছেন। দু’বোনে কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এসব। গল্প শুনতে শুনতে এখন আমরা আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। আপনাকেও অনেকটা নিজের লোকই ভাবি।
‘নিজের লোক’! নূপুরের ভালো লাগে শুনতে। নিজের লোক বলতে তারই বা আছে কে এখন!
নির্মলার সঙ্গে যখন কথা হয়েছে রাতের দিকে, ভারতের ভিসা, ফ্লাইট টিকিট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কথা দু’চার মিনিটে সেরে দু’জন শুরু করে চুড়ান্ত অপ্রয়াজনীয় কথা। আপনি থেকে তুমিতে চলে আসে সম্বোধন প্রথম দিনেই।
–যমুনাদিকে অনেকদিন দেখিনি। পাঁচ বছর। পাঁচ বছর আগেই তো গিয়েছিল আমেরিকায়। এমএসএনে, ইয়াহুতে বা স্কাইপেতে আগে দেখতাম, কথা হত। সেও অনেকদিন আর হয় না। চুল পেকেছিল?