- বইয়ের নামঃ ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে
- লেখকের নামঃ তসলিমা নাসরিন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে – অধ্যায় ১ – মৃত্যু
নূপুর খবরটা পায় সকালে। সারাদিন কাউকে জানায় না। কাকেই বা জানাবে! কে তার পাশে এ সময়ে দাঁড়াবে! আত্মীয়দের মধ্যে এমন কেউ নেই যে কিনা খবরটা শুনে বিচলিত হবে, মুষড়ে পড়বে, বা চোখের জল ফেলবে। উপদেশ হয়তো কেউ কেউ দেবে। কিন্তু যাদের কোনও কিছু যায় আসে না যমুনার-কী-হল-না-হল’য়, তাদের উপদেশ শোনার চেয়ে, নূপুর ভাবে, তার নিজের যা ভালো মনে হয় তাই করা উচিত। ভেবেও নূপুর জব্বার চৌধুরীকে ফোন করে সন্ধ্যের দিকে। জব্বার চৌধুরীর বয়স প্রায় পঁচাত্তর। খবরটা শুনে জানতে চাইলেন যমুনা আমেরিকায় থাকতো কিনা। ভারতে থাকতো শুনে তাঁর রাগ হয় খুব। বললেন, ‘ইণ্ডিয়ায় কেন থাকতে গেছে? ও কি জানে না ইণ্ডিয়া বাংলাদেশকে পানি দিচ্ছে না? ইণ্ডিয়াকে বয়কট করা উচিত ছিল যমুনার’। জব্বার কাকার কথা এরপর আর শুনতে ইচ্ছে করেনি। সুলেখাকে জানায় নূপুর। সুলেখা খালাতো বোন। যমুনার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল দেশে থাকাকালীন। খবরটি যে কোনও খবর শোনার মতোই শুনলো, বললো, ‘সবাইকেই যেতে হবে নূপুর। নিজে কী পূণ্য কামাই করলে, সেটা দেখ। সবাই ইয়া নবসি ইয়া নবসি করবে। যমুনা আজ গেছে, কাল আমরা যাবো’। আহ, সবাইকে যে যেতে হবে, যেন নূপুর এ কথা আগে জানতো না!
রাত দশটার দিকে নূপুর নাইমকে ফোন করে। এ ফোনটি করার কোনও মানে হয় না জেনেও ফোনটি করে। জানে যমুনার যদি বাধা দেওয়ার কোনও সুযোগ থাকতো, এই ফোনটি করতে সে বাধা দিতই। জেনেও সে খবরটা জানায় নাইমকে। পরিবারের লোক হিসেবে জানার অধিকার তার আছে বলেই জানায়, এ ছাড়া আর কোনও কারণ নেই। ফোনটি করার আগে নূপুর নিজেকে বার বারই কথা দেয়, সে কাঁদবে না। কারণ আর যার কাছেই হাহাকার করা মানায়, নাইমের কাছে মানায় না।
ফোন ধরেছিল নাইমই।
–দাদা, তপু ফোন করেছিল।
–তপু কে?
–বুবুর মেয়ে।
–যমুনার মেয়ে?
–তোমার তো জানার কথা যে বুবুর মেয়ের নাম তপু। তপু এখন আমেরিকায় পিএইচডি করছে। হারভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। ফিজিক্সে।
–এই তপুই সেই তপু তা জানবো কী করে? তা ফোন করেছে বলে আমার হয়েছেটা কী? আমার কী করার আছে। এ বাড়ি আমার। তুই কোনও অপু তপুর হয়ে তদবির করবি না, আগেই বলে দিয়েছি। কোন বাস্টার্ড কী করলো, ফোন করলো কী করলো না, আই ডোন্ট কেয়ার।
–আমি জানি তুমি কেয়ার করো না। বুবুর ফ্ল্যাটটায় তুমি আজ প্রায় , কত বছর হল, পঁচিশ বছর, আছো। লোকে এখন ওটাকে তোমার ফ্ল্যাট বলেই জানে, এ কথা তুমিও জানো। এ নিয়ে কথা বলার জন্য আমি ফোন করিনি। তপুও আমাকে ফ্ল্যাট নিয়ে কথা বলতে ফোন করেনি। আসলে দেশের বাড়িঘর নিয়ে তপুর কোনও আগ্রহ নেই।
–তাহলে কে ফোন করেছে না করেছে তা শোনাতে গভীর রাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলছিস কেন?
–ও, তুমি এই দশটাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে? তাহলে কাল ফোন করি। বরং কালই কথা বলি। তুমি ঘুমোও।
–কাল আমার সময় নেই। আজই বল যা বলার। ফ্যামিলির পেছনে সব এনার্জি খরচ করেছি। আর আমি পারবো না। আমার একটা লাইফ আছে, নাকি নেই?
–এনার্জি যদি খরচ করে থাকো, সে তোমার নিজের ফ্যামিলির পেছনে করেছো। আমার আর বুবুর জন্য তোমার পকেটের দু’পয়সাও খরচ হয়নি কোনোদিন। কোনও এনার্জিও খরচ হয়নি। যদি কখনও এনার্জি খরচ করে থাকো, সে আমাদের ঠকাবার ফন্দি আঁটার এনার্জি, আর কিছুর নয়।
–কী বলতে চাস তুই?
–তুমি ভালো করে জানো কী বলতে চাই।
–এত রাতে ফোন করেছিস কেন?
–খুব বেশি রাত হয়নি। রাত দশটায় তুমি ঘুমোওনা। দশটার পরে তোমার মদ খাওয়া শুরু হবে। রাত দুটো তিনটেয় ঘুমোবে তুমি।
–তাতে তোর কী! আমার পয়সায় আমি মদ খাই। তোর পয়সায় মদ তো খাই না।
–হিসেব করে দেখো, আমার আর বুবুর পয়সায় অনেক খাচ্ছো। বাবার জমিজমা টাকা পয়সা একা আত্মসাৎ না করলে, তিনজনের মধ্যে সবকিছু ভাগ করলে, তোমার ‘তোর পয়সায় বা তোদের পয়সায় মদ খাই না’ এ কথাটা বলা সাজতো।
–তোর এইসব প্যানপ্যানানি শুনতে আমি পারবো না। তোকে আমি ফাইনাল বলে দিয়েছি, বাবার সম্পত্তি নিয়ে কোনও কথা বলতে পারবি না। আমাদের ময়মনসিংহের বাড়ি তোকে আমি লিখে দিয়েছি।
–না, তুমি লিখে দাওনি। এ বাড়ি আমি কিনে নিয়েছি। বাজারে যা দাম, তার দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনেছি।
–তোর বাজে কথা অনেক সহ্য করেছি। বাড়ি বাজারের চেয়েও কম দামে তোকে দিয়েছি।
–তুমিও জানো তুমি মিথ্যে বলছো, এ বাড়ির দাম যখন দু’ কোটি টাকা, তুমি চার কোটি নিয়েছো।
–এই জন্যই বলি মেয়েমানুষের সঙ্গে কারবার করতে নেই। তোর কাছে বিক্রি করাই উচিত হয়নি।
–করেছো টাকার লোভে। এতগুলো টাকার লোভ কী করে সামলাবে!
–দ্বিগুনই যদি দাম নিই, তুই কিনলি কেন? তোর কোনও স্বার্থ না থাকলে তুই কিনেছিস আমার বাড়ি?
–প্রথমত এটা তোমার একার বাড়ি নয়। আমি আর বুবুও এই বাড়ির ভাগ পাই। কিন্তু যেহেতু তুমি একাই গায়ের জোরে বলছো এই বাড়ি তোমার, এই বাড়ি তোমাকে লিখে দিয়ে গেছে বাবা, যেহেতু তুমি আমাদের ভাগ আমাদের দেবে না, অগত্যা কিনেছি। দ্বিগুণ বেশি দাম দিয়ে কেনার কারণ, স্মৃতি। আর কিছু না। বাড়িটার ওপর টান আছে বলে কিনেছি।
–তোর টান আছে, আমার টান নেই? ওই বাড়িতে আমি থাকিনি? তোরাই থেকেছিস?
–থেকেছো কিন্তু টান নেই। টান থাকলে দশগুণ দাম পেলেও তুমি বিক্রি করতে না। যেমন আমি করবো না। যাকগে, এসব পুরোনো কথা। একই কথা বহুবার হয়েছে আমাদের মধ্যে। বলতে চেয়ছিলাম তপু ফোন করেছিলো।
–আশ্চর্য! ও তোকে ফোন করে, তুই ওকে ফোন করিস। এসব তোদের ব্যপার। আমাকে জানানোর মানে কী?
–তপুর সঙ্গে মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয় আমার। তপুকে কি কোনোদিন ফোন করেছো? জানো ও দেখতে কেমন? কবে ওকে শেষ দেখেছিলে? কোনওদিন জানতে চেয়েছো ওর কথা? ও কেন তোমাকে ফোন করবে! বেচারা জানেও না ফ্যামিলি কাকে বলে। একবার শখ করে এসেছিল নিজের দেশ দেখতে, আত্মীয় স্বজনদের দেখতে, ওর নিজের মা’র ফ্ল্যাটটাতেই তো থাকতে দাওনি। কী যেন বলেছিলে? গেস্ট আছে। গেস্ট মানে তো তোমার শ্বশুরবাড়ির লোক। ওরা তো সারা বছর বুবুর ফ্ল্যাটেই থাকে। তপুর জন্য জায়গা হয়না। ওকে হোটেলে উঠতে হয়েছিল।
— ফ্ল্যাট নিয়ে এত কথা বলবি না, নূপুর। সহ্যের একটা সীমা আছে আমার। আমি যদি ফ্ল্যাটটা না টেক কেয়ার করতাম, এটা এতদিনে পাড়ার গুণ্ডাপাণ্ডারা নিয়ে নিত। আমি দেখাশুনা করছি, মেইনটেইনেন্স দিচ্ছি। কম টাকা খরচা হচ্ছে আমার?
–থাকছো যখন বাড়িতে, তোমার ময়লা ফেলার খরচা, তোমাকে পাহারা দেওয়ার খরচা তো তোমাকে দিতেই হবে। বাড়িটায় ভাড়াটে থাকলেও তাই করতো।
–তুই এতকাল আমেরিকায় কাটিয়েছিস। তুই এদেশের অনেক কিছু জানিস না। আমি না থাকলে অনেক ক্ষতি হত ফ্ল্যাটের।
–তুমি না থাকলে একটা লাভ হত, বুবু ফ্ল্যাটটা বিক্রি করতে পারতো।
–বিক্রি? যমুনা ফ্ল্যাট কী করে বিক্রি করতো, শুনি? ও কি দেশে আসতে পারতো বিক্রি করতে? এয়ারপোর্টে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোমরে দড়ি বেধে জেলখানায় নিয়ে যেতো।
–বাজে কথা বলো না।
–আমি বাজে কথা বলি না।
–বুবুর বিরুদ্ধে কেউ মামলা করেনি। কে তাকে জেলখানায় নিত? কেন নিত?
–এলেই মামলা করতো। ভালো যে আসেনি। বাই দ্য ওয়ে, তপু কেন ওর বাবার ফ্যামিলির কাউকে দেখতে যায়নি? ওই ফ্যামিলি কেন ওকে রিসিভ করলো না? বাড়িতে রাখলো না? গুলশানে তো বিরাট বিরাট বাড়ি আছে ওর বাবার!
— এসব কেন বলো! তুমি ভালো করেই তো জানো ওরা কেউ জানে না তপুর কথা। বাবা বা বাবার ফ্যামিলি সম্পর্কে তপু নিজেও কিছু জানেও না। কোনও আগ্রহ জন্মায়নি তপুর। তপু মানুষ হয়েছে তপুর মা’র কাছে।
–সো?
–সো আবার কী? তোমাকে ইনফরমেশনটা দিলাম। তুমি জানো, তারপরও দিলাম। কনভেনশানাল জীবনের বাইরেও জীবন থাকে মানুষের। কোনোদিন কি বুঝতে চেয়েছো? শুধু নিজের স্বার্থটাই দেখে গেছো।
–শোন তোর এসব কমপ্লেইন শুনলে আমার চলবে না। তোর কাজকম্ম নেই। বসে বসে আমেরিকার ডলারে ল্যাভিস লাইফ লীড করছিস। আমাকে খেটে খেতে হয়। অনেক কাজ পড়ে আছে। আমি রাখি।
নূপুর থামায় নাইমকে। ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে বলে — আমার এটা জানানো কর্তব্য বলেই জানাচ্ছি। পরে আমাকে যেন দোষ না দাও, আবার যেন না বলো যে আমি কোনও বদ উদ্দেশে খবরটা গোপন রেখেছি। শোনো, তপু জানালো বুবু মারা গেছে।
কিছুক্ষণ কোনও শব্দ নেই।
একটা স্তব্ধতা ফোনের দু’পারেই।
নূপুরের চোখে জলের ধারা। বাঁ হাতে ফোনের রিসিভার। ডান হাতে মুখ চেপে রাখা। নাইম যেন কোনো আর্তস্বর না শোনে।
–ও এই কথা?
নাইম প্রথম কথা বলে।
নূপুর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে –হ্যাঁ এই কথা। এও জানালো, তপু ইণ্ডিয়ায় যাবে না, ওর মাকে ও যেমন হাসিখুশি, লাইভলি দেখেছে, ওই স্মৃতিটাই রাখতে চায়। ও বুবুর ডেডবডি দেখতে চায় না।
–চায় না তো আমাকে জানাচ্ছিস কেন!
–না, তোমাকে কোনও কতর্ব্য পালন করার জন্য জানাচ্ছি না। যা করার আমিই করবো। আমি চাইও না তুমি বুবুর কোনও কিছুতে নাক গলাও। পঁচিশ বছর তোমার কিছু যায় আসেনি বুবুর কোনো কিছু নিয়ে, এখনও সেভাবেই থাক। শুধু বুবুর বদনামটা যেমন করে গেছো এতকাল, সেটা অন্তত কোরো না কিছুদিন। আমি কলকাতা যাচ্ছি শিগগির। তোমাকে ফোন করেছিলাম শুধু এটুকু জানাতে, তোমার ছোট বোন যমুনা আর নেই। এটুকু, পরিবারের লোক হিসেবে জানানো কর্তব্য বলেই জানিয়েছি।
নূপুর নিজেই ফোন রেখে দেয়। রেখে দেয় কারণ তার হাত কাঁপছে, তার ঠোঁট কাঁপছে। ফোন রেখে তাকে বারান্দায় ছুটে যেতে হয়, লম্বা শ্বাস নিতে হয়। চিৎকার করে তাকে কাঁদতে হয় কিছুক্ষণ।
ফোন বেজে গেছে এর পর। নাইম করেছে ভেবেই ফোন সে ধরেনি। ফোন ধরেনি, কারণ সে কেঁদেছে। শুয়েছে। বারবার খাট থেকে নেমেছে। জল খেয়েছে। আবার শুয়েছে। এপাশ ওপাশ করেছে। বুকে চিনচিন ব্যাথা। ফুঁপিয়েছে। শান্ত হয়েছে। সারারাত যমুনার কথাগুলো মনে বেজেছে। যমুনা বলতো, ‘আয়, নূপুর একবার আমার কাছে আয়, অনেকদিন তোকে দেখি না’। যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি নূপুরের। আর কিছুদিন বা ক’টা মাস পরই হয়তো যেত। বাড়িটা গুছিয়ে নিয়েই যেত। বাড়িটা গোছাতে গোছাতেই বছর চলে গেল। যমুনা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এত কী গোছানোর আছে!’ নূপুর ঠিক কী বলবে বুঝে পায়নি। আসলে যমুনার ওই দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরেই ‘কী করছিস চলে আয়’-এর আহবানকে অবজ্ঞা করতে করতে অবজ্ঞা করাটাই অভ্যেসে দাঁড়িয়েছিল।
একটা ভীষণ বিষণ্ন অসহ্য রাত্তির যায়, সকালের দিকে রাস্তায় পড়ে থাকা এতিম শিশুর মতো কুঁকড়ে শুয়ে থাকে নূপুর। প্রতিদিনের মতো চা দিয়ে যায় দুলি। চা ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে থাকে। বারোটায় নাইমের ফোনে ঘুম ভাঙে।
–কী হয়েছিল রে? কী অসুখ? বলতে চাইছি কী অসুখে মরলো? নাইম জিজ্ঞেস করে। গলাটা ভাঙা।
নূপুর দুলিকে ডেকে ওই ঠাণ্ডা চা’টাই গরম করে দিতে বলে। চা না খেলে নূপুর দিন শুরু করতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘জানি না দাদা। মনে হয় হার্ট অ্যাটাক। ব্লাড প্রেশার তো বেশি ছিল’।
–প্রেশার কবে থেকে? প্রেশার তো আমারও আছে।
–হ্যাঁ বাবার কাছ থেকে ওই প্রেশারটা পাওয়া। তুমিও পেয়েছা, বুবুও পেয়েছে।
–ওষুধ খেতো না নাকি?
–খেতো তো।
–খেলে হার্ট অ্যাটাক হবে কেন?
–প্রেশার না থাকলেও তো হার্ট অ্যাটাক হয়! কোলেস্টারোল বেশি হলে বা ব্লাডক্লট বেশি হলে। কী কারণে বুবুর এমন অ্যাটাক হল, তা জানা দরকার।
–অবশ্য বয়সও তো হয়েছিল। কিন্তু ওর মেয়ে কী বললো, কীভাবে মারা গেছে?
–না, ও কিছু বলেনি। ওকে কেউ একজন ফোনে জানিয়েছে বুবু মারা গেছে।
–কে জানিয়েছে ওকে?
–কলকাতা থেকে একজন জানিয়েছে।
–যে জানিয়েছে, সে কী যমুনার কিছু হয়? মানে কোনও রিলেটিভ? ওই সময় ছিল সে? মানে মারা যাওয়ার টাইমে ছিল? নাম কী লোকটার?
— কে খবরটা জানালো তপুকে, এটা তো কোনও ইম্পর্টেন্ট কোনও বিষয় না! রিলেটিভ বুবু কলকাতায় কোথায় পাবে? বুবু তো একাই থাকতো! কোনও বান্ধবী বা কলিগ হয়তো জানিয়েছে।
–তুই কেন জিজ্ঞেস করিসনি কে ফোন করেছিল তপুকে, কে জানিয়েছে খবরটা? যে ফোন করেছিল, তার ফোন নম্বরটা বরং নে। তার সঙ্গে সরাসরি কথা বল। কী হয়েছিল, ঘটনা কী, সবকিছু জানতে চা। হুট করে কোনও ডিসিশান নিস না। এটা উড়ো কোনো খবর কিনা যাচাই করে দেখ। কলকাতার মানুষ কিন্তু ভালো না। হয়তো যমুনার টাকা পয়সার লোভে ওকে গুম করে দিয়েছে।
–তপু বলেছে, মহিলা কী যেন নাম আরতি বা নিয়তি বুঝতে পারছে না একা কী করে কী করবে। তপুকে কলকাতায় যেতে বলেছে। বলেছে লাশ আমরা মর্গে রেখে দিচ্ছি। তুমি এসে যা করার করো। এও জানিয়েছে বুবু নাকি ডেডবডি মেডিকল কলেজে দান করে গেছে।
–কী করে গেছে?
–দান করে গেছে।
–পুরো বডিটাই?
–হুম।
–মেডিকেল কলেজ ওর বডি দিয়ে কী করবে?
–বডি কেটে কেটেই তো শেখে স্টুডেন্টরা। তাছাড়া ডেডবডি রিসার্চের কাজেও লাগে।
–বডির কি অভাব আছে নাকি আজকাল? বডি দিয়েছে ভালই করেছে। বডি বহন করার ঝামেলা গেল। বাঙালিরা বিদেশ থেকে বডি আনছে দেশে। খরচও তো সাংঘাতিক। আমি তো বলি ওদের, যেখানে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছে, সেখানে কবর দাও, বডি দেশে আনার দরকারটা কী। ওদের জানিয়ে দে, মেডিকেলে দিয়ে দিতে।
–ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি গেলেই নাকি সব হবে।
–কবে যাবি?
–যাবো, কালই যাবো।
–বাড়ি গাড়ি আছে?
–মানে?
–মানে বাড়ি গাড়ি আছে কি না। সহায় সম্পত্তি কোথায় কী অবস্থায় আছে তা দেখতে হবে তো।
–এই সময় বিষয় আশয় নিয়ে চিন্তা করছো? মানুষটা মারা গেছে, দাদা। মানুষটা আর নেই।
–শোন, যা কিনেছে সব বিক্রি করে দিয়ে আয়। ভ্যালুয়েবল জিনিসপত্র, সোনা দানা টাকা পয়সা এসব শুধু নিয়ে আয়। অন্য কিছু আনিস না। দেখা যাবে, ওসবের যা দাম, ট্রান্সফার করতে গেলে তার চেয়ে দাম পড়েছে বেশি। কিছু অসুবিধে হলে বাংলাদেশ অ্যামবেসির সঙ্গে যোগাযোগ করিস। ওখানে আমার এক বন্ধু আছে, কামাল চৌধুরী, আমি ওকে জানিয়েও রাখবো।
–ঠিক আছে।
–আসলে আমারই যাওয়া উচিত। তুই কি এত সব পারবি? তুই পারবি না। একটা পুরুষমানুষ থাকা উচিত।
–না না না, আমিই পারবো। না পারার কী আছে! বুবুর দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, ওরা নিশ্চয়ই হেল্প করবে। কী যেন নাম, মুন, আর বোধহয়, গার্গী। ওদের ঠিকানা ফোন নম্বর কিছুই অবশ্য এখন আমার কাছে নেই। ও বের করে নেওয়া যাবে। একবার তো গিয়েছিলাম কলকাতায়। ঢাকা হয়ে আমেরিকা যাওয়ার পথে থেমেছিলাম। দু’দিন ছিলাম। জয় তখন কোলে। ওদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বুবু একটা ভাড়া বাসায় থাকতো। তপু ছোট ছিল। কলকাতার ভালো একটা ইস্কুলে বুবু ওকে ভর্তি করানোর জন্য খুব চেষ্টা করছিল। বলেছিল আর ক’টা দিন থাকতে। জয় এত বিরক্ত করছিল, থাকিনি।
–শোন, কাজের কথা বলি। ওখানকার কোন ব্যাংকে কত আছে, এসব জানতে হবে। আর ইণ্ডিয়া থেকে বাংলাদেশে অত সহজে টাকা ট্রান্সফার করা যায় না। পারমিশান টারমিশান নেওয়ার ব্যাপার আছে। আমার তো ভারতের ভিসা আছে, গত মাসে নিয়েছিলাম। নতুন একটা ব্যবসা শুরু করার জন্য দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। ওই ভিসায় ঘুরে আসতে পারবো। দেখি কালকের একটা টিকিট করতে পারি কি না।
— সব কিছু আমিই পারবো, দাদা। তোমার দরকার নেই যাওয়ার।
–দরকার নেই মানে?
–মানে তোমার সঙ্গে তো ভালো সম্পর্কটাও ছিল না। তুমি তো বুবুর খোঁজও নাওনি। এক আমিই যা নিয়েছি। অবশ্য আমিই বা কত খোঁজ নিয়েছি। আমারও ঝামেলা টামেলা ছিল। সব সময় যোগাযোগ করতে পারিনি। নিজের সংসার নিয়েই তো ডুবে ছিলাম। কনটাক্ট বেশিরভাগ বুবুই করতো। সবসময় তো ফোনও ধরতাম না। ডিপ্রেশনে থাকলে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হয়না। জানিনা বুবু বুঝতো কিনা। অনেক কিছুই তো ও বুঝতো। বুবুটা খুব একা ছিল। ফ্যামিলির কারো সাপোর্ট পায়নি। যদি পেতো..
নূপুরের কথা শেষ না হতেই ধমকে ওঠে নাইম।
–ফ্যামিলির সাপোর্ট কী করে আশা করে? আমরা যে ওর বিরুদ্ধে কেইস করিনি, পুলিশে খবর দিইনি, এটাই তো বেশি। আর কী চায় ও?
–না, কিছু চায় না। চাওয়ার জন্য তো আর বসে নেই! তুমি কেন সাপোর্ট করবে, তাই তো! বুবু ফিরে আসবে বলে তোমার ভয় ছিল, ফ্ল্যাটটা যদি ফেরত চায়! সেই ভয়টা এখন নিশ্চয়ই জন্মের মতো গেছে। বেশ চেঁচিয়ে কথা টথা বলছো। তোমার মনটা কী দিয়ে গড়া, বলো তো? আমরা তো একই মা’র সন্তান! কেন তুমি এত ভিন্ন মানসিকতার! মাঝে মাঝে ভাবি, তুমি মা’র পেটেই ছিলে তো! নাকি কোথাও থেকে এনে তোমাকে অ্যাডপ্ট করেছে!
— বাজে কথা রাখ। তোর বোনকে ফ্যামিলি সাপোর্ট করেনি। লজ্জা করে না বলতে? একটা মার্ডারারকে সাপোর্ট কী করে করবো আমরা? ও তোর বোন হতে পারে, কিন্তু ভুলে যাবি না ও একটা লোককে খুন করেছে। একটা খুনীর জন্য অত দরদ কেন তোর? তাহলে বলতে হবে খুনের পেছনে তুইও ছিলি। আমাদের চৌদ্দ পুরুষের কেউ কখনও খুন করেছে? আমি খারাপ, আমি অমানুষ, নাকি যমুনা খারাপ, যমুনা অমানুষ? লোকদের জিজ্ঞেস কর, কী বলে দেখ। দেখ সবাই কাকে অমানুষ বলে। খুনী মরেছে তো কী হয়েছে! খুনী মরুক, তাই তো সবাই চায়! খুনীরা জেল খাটে, খুনীদের ফাঁসি হয়, যাবজ্জীবন হয়। আর ওর তো কিছুই হয়নি। দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে দিব্যি আরামে ছিল এতগুলো বছর। এখনও মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। খুনীর ভাই বলে এখনও লোকে আঙুল তুলে দেখায়।
— চিরকাল তো একই কথা বলছো। অন্তত আজকের দিনটা বন্ধ করো এসব কথা। মানুষটা ছিল, মানুষটা নেই!
–সো?
–সো একটু ভাবো ওর কথা। ও কি ভালো কিছু করেনি? শুধু খুনই করেছে? খুন তো অকারণে করেনি।
–সব খুনীই বলে যে খুন করার পেছনে কারণ ছিল।
নাইম আরও কিছুক্ষণ চেঁচায়। আরও কিছুক্ষণ যমুনাকে কুচি কুচি করে কেটে ওতে নুন আর লঙ্কা ছিটিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। গলার স্বরে তীব্র রোষ, বিদ্রুপ, ঘৃণা। নূপুর ফোন রেখে দেয়। যমুনার প্রসঙ্গ উঠলে নাইম এমন কম দিনই আছে, যেদিন যমুনাকে খুনী বলে গালি দেয়নি! আজকের দিনটা অন্তত অন্য রকম হতে পারতো। আজকের দিন অন্য দিনের মতো নয়। আজ যমুনা নেই। নূপুরের আজ কোনও মন্দ কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না।
নূপুর জানে নাইম মিথ্যে কথা বলছে। নাইমকে খুনীর ভাই বলে কেউ আঙুল তুলে দেখায়, এ নূপুরের বিশ্বাস হয় না। যমুনা না জানালে হয়তো কেউ জানতোই না খুনের ঘটনাটি। আর নূপুর নাইমকে তখন না জানালে নাইমও জানতে পারতো না। নূপুরের বিয়ের উৎসব জাঁক জমক করার পেছনে নাইমের বড় একটা ভূমিকা ছিল, সে কারণেই কী না নূপুর জানে না নাইমের ওপর তার বেশ একটা বিশ্বাস জন্মেছিল। বিশ্বাস জন্মেছিল বলেই যমুনা যে কথা শুধু তাকেই বলেছিল শুধু , নূপুর সে কথা এর ওর কানে দিয়েছিল? নূপুর কি ভেবেছিল কাছের মানুষগুলোকে জানিয়ে রাখলে বিপদ আপদে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে! নাকি যমুনার ওই খুনটাকে মনে মনে সে মেনে নিতে পারেনি বলেই রাষ্ট্র করেছিল!
জীবনকে যদি পেছনে নেওয়া যেত। একটা শুধু রিমোট কন্ট্রোল থাকতো, তাহলে ভুলগুলো শুধরে নেওয়া যেত। বড় অসহায় বোধ করে নূপুর। এরমধ্যে আবার ভীষণ মাথা ধরে। এই মাথা ধরা রোগটা বাড়ে যখন কারও কুৎসিত ব্যবহার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। এই কারণেই নূপুর চায় না নাইমকে ফোন করতে, ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্টের কথা জানাতে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে নাইম সবসময়ই বেশ দক্ষ।