কিষান তখনও সোফায় বসা, শার্টের বোতাম ফেটে পেট বেরিয়ে আছে। পেট না তো পেটের তেল।
ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে সে। মোচের তলে কোদালি দাঁত বেরিয়ে এসেছে, পেটের তেলও সে হাসিতে আরও বেরিয়ে আসে।
সানালের প্রস্থানের পর সুনীল আর চৈতালি যাবার উদ্যোগ করে।
কী ব্যাপার সবাই চলে যাচ্ছেন! বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। থেকেই যান না আজ রাতে। চৈতালির হাতখানা নীলা ধরে রাখে নিজের শক্ত হাতের মুঠোয়।
পাগল মেয়ে। সুনীল দম টেনে হাসে।
নীলার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে হুক থেকে নামিয়ে ওর গরম কোট পরে নেয় চৈতালি।
ওরা অদৃশ্য হতেই হঠাৎ এক স্তব্ধতা বন্ধ জানালা দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে। উৎসব শুরু হয় স্তব্ধতার মাতাল নৃত্যের।
নীলা একা বোধ করে, যদিও ঘরে সে একা নয়।
নীলা একা বোধ করে, যদিও জানে ঘরে যে মানুষটি বসে আছে, সে তার পরম আত্মীয়, তার স্বামী।
.
বিছানায় ওভাবেই ওরকম গা ভর্তি অলংকার আর কাতান পরেই (দ) হয়ে শুয়ে থাকে নীলা। আর কিষান সেই দ ভেঙে(1) করে বুকের আঁচল সরিয়ে ব্লাউজের বোতাম পটাপট খুলে নেয়, কাঁচুলি ঠেলে সরাতেই নীলার স্তনজোড়া লাফিয়ে ওঠে। শক্ত আঙুলে সেদ্ধ আলু ডলার মতো দুরন্ত স্তনদুটোকে ডলে নিস্তেজ করে কিষান। ফোঁস ফোঁস শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই ঘরে। কিষানের লোমশ শরীরের তলে সে নিসাড় পড়ে থাকে। নিজেকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি সুখ পাও এ সবে?
নিজেকেই উত্তর দেয়, না।
২. সংসারধর্ম
১.
ওঠো ওঠো।
ওঠো ওঠো বেলা অনেক।
সারারাত ঘুম হয়নি তার, ভোরের দিকে ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছিল। ডাক শুনে সে ধড়ফড়িয়ে ওঠে, এ কোথায় নীলা, এ তার কলকাতার ঘর নয়, এ তার বিছানা বালিশ নয়। কিষানের দিকে চোখ পড়তে, কিষানের মোটা কালো মোচে, হোঁদল কুতকুতে চোখে, বসন্তের দাগ বসা গালে, তার চেতন ফেরে, এ তার স্বামীর ঘর, স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে সে এখানে, এই রু দ্য ফুবো সানদানিতে, এই ছ’তলায়, এই প্যারিসে, ধবধবে সাদা বিছানা বালিশে। কিষান কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে স্নানঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, দেখো তো কাল রাতের বাসনপত্র ওভাবেই পড়ে আছে।
ওসব যে পড়ে আছে, নীলা রাতেই দেখেছে। বাসনপত্র কলকাতার বাড়িতে এরকম পড়ে থাকলে কোনওদিন সে ফিরে তাকায়নি। বাসন সরিয়ে নেবার, ধোবার, গুছিয়ে তুলবার লোক আছে। কিষান স্মরণ করিয়ে দেয়, কলকাতায় রাজার হালে বাস করা গেলেও প্যারিসে যায় না। এখানে মেথরের কাজও নিজের হাতে করতে হয়। কলকাতায় হলে নীলা অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়েই কাটাত। চিত্রা চা আর খবরের কাগজ দিয়ে গেলে চা খেয়ে কাগজ পড়ে তবে বিছানা ছাড়ত। বিছানা ছেড়ে আরেক দফা চা। এ বাড়িতে চিত্রার বংশও নেই। নীলাকেই উঠতে হবে। উঠে কাল রাতের এঁটো বাসনপত্রের ঝামেলাও নীলাকেই ঘোচাতে হবে। ওঠে সে।
সুতি একটি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে, চা চড়াতে রান্নাঘরে ঢুকে আঁতিপাতি করে খুঁজেও চা পাতা না পেয়ে, স্নানঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, চা পাতা কোথায় রেখেছ?
কিষান স্নান সেরে দাড়ি কামাচ্ছিল, অর্ধেক গাল ফেনায় সাদা, অর্ধেক কামানো। আয়না থেকে মুখ ফিরিয়ে, চোখে বিস্ময়ের ফেনা তুলে বলে, চা কে খাবে, চা তো আমি খাই না!
বলো কী! চা খাও না তুমি?
নীলার নেত্ৰমলে সংশয়। কৈশোর পার হয়েছে, অথচ চা পান করে না, ভারতবর্ষে এমন লোক নীলা কখনও দেখেনি।
নাহ।
আবার আয়না। ফেনার গাল টান করে ধরা। ফেনার গালে ধারালো ব্লেড।
আমার চা না হলে চলে না, সকালে অন্তত দু কাপ আমার লাগেই। নীলা দরজায় দাঁড়িয়ে আঙুলে চোখের পিঁচুটি মুছতে মুছতে বলে। পিঁচুটি যায়, সংশয় লেগে থাকে। ও আঙুলে ওঠে না।
চায়ের নেশা করো নাকি?
নেশা ঠিক না। অভ্যেস। নীলা বলে।
এই তো মুশকিলে ফেললে।
মুশকিলে?
এক বাড়িতে দুরকম অভ্যেস থাকলে মুশকিলই তো।
.
নীলা স্নানঘরের দরজা থেকে সরে আসতে আসতে শোনে কিষান বলছে, আমার দেরি হয়ে গেল।
পাঁউরুটি, মাখন, জেলি, কমলার রস, টেবিলে সাজিয়ে দেয় সে। স্বামী যখন সকালে আপিসে যায়, ঘরের বউদের ব্যস্তসমস্ত হয়ে এভাবেই প্রাতরাশের আয়োজন করতে হয়। বুদ্ধি হবার পর থেকে সে দেখছে, অনির্বাণের কখনও আওয়াজ দিতে হয় না যে তাঁর দেরি হচ্ছে বা কিছু, ভোরবেলা নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে মলিনা উঠে যান রান্নাঘরে, স্বামীর জন্য নিজে হাতে রুটি বেলে ভেজে গরম গরম আলুপুরি ডালপুরি, অনির্বাণের মুখে যা যা রোচে, ঠিক তাই তাই তৈরি করেন। সংসারধর্মে মলিনার কোনওদিন কোনও ত্রুটি হয়নি। নীলা মলিনার কন্যা, লোকে বলে মায়ের মতোই নাকি নম্র, শ্লীল, সুবোধ, শান্ত সে, মায়ের মতোই প্রিয়ংবদা, তার কেন ত্রুটি হবে স্বামীসেবায়।
গতরাতের বাসনপত্রও তড়িঘড়ি সরিয়ে নেয় নীলা।
কিষান সুটেড বুটেড সাহেব, টেবিলের সরঞ্জাম দেখে বলে, বাহ বেশ লক্ষ্মী বউ তো তুমি!
কেন লক্ষ্মী বলছ, টেবিলে খাবার এনে রেখেছি বলে?
কেবল কি তাই! কিষান চোখ ছোট করে হাসে।
অনির্বাণ এরকমও কখনও হাসেননি মলিনার দিকে চেয়ে। বরং প্রায় দিনই অনুযোগ করেছেন, সবজিটা একটু কম সেদ্ধ হয়েছে, ডিমের কুসুমটা ভেঙে গেছে, রুটির কোনাটা পুড়ে গেছে বলে। নীলা নিজের ভাগ্যকে বাহবা দেয় কিষানকে অসন্তুষ্ট তো নয়ই, বরং অল্পতে তৃপ্ত হতে দেখে।