চৈতালি চেঁচায়, তারিক যা বলেছে, তা কি কেউ অনুগ্রহ করে অনুবাদ করে দেবেন, অডিলের জন্য?
অডিল সাহানা আর বাবুর সঙ্গে ফিসফিসে ব্যস্ত ছিল। চকিতে মুখ তোলে, কেউ কি বদনাম করছ নাকি আমার!
আরে বলছেন কী, সানাল বলে, বদনাম হবে কেন! যা বলছে সত্য বলছে, তবে সত্যটা বানিয়ে বলছে।
তারিক হেসে বলে, জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছি, কিন্তু আমার বউয়ের মতো সুন্দরী আর কাউকে দেখিনি।
অডিলের গোলাপি মাড়ি অনেকক্ষণ বেরিয়ে থাকে।
.
আড্ডা, হঠাৎ কেউ লক্ষ করে না, টুকরো হয়ে যায়, এক দলে রাজেশ বাবু আর তারিক।
বুঝলে হে ভারতের অর্থনীতি আগামী দশ বছরে বিষম পালটে যাচ্ছে….
ধুর, ও গরিব, গরিবই থাকবে, দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে…
পুরো সিলিকন ভিলি চলে গেছে ভারতীয়দের হাতে। ইয়োরোপও এখন কমপিউটারদক্ষ লোক আনতে ভারতে ধর্না দিচ্ছে।
আরে টাকা ওই হাতে গোনা কিছু লোকের হাতে, বেশির ভাগ লোকই তো না খেয়ে মরছে।
না খেয়ে মরতে আমি পুরো ভারতে একটি লোককেও দেখিনি। সব পশ্চিমি প্রচার।
জনসংখ্যাই দেশটিকে মারছে।
তা কেন, জনতা হল শক্তি, একে কাজে লাগাও। ইয়োরোপের কলকারখানা বন্ধ হবার জোগাড় হয়েছিল, অন্য দেশ থেকে শ্রমিক না এনে এদের উপায় ছিল না।
আরেক দলে কিষান আর বাবু গোগিনি মুখে ফেনা তুলছে বলে যে
কংগ্রেস গেছে। একশো বছরেও আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
বিজেপির ওপরও আর ভরসা করা যাচ্ছে না। বাজপেয়ী আছে বলে বাঁচোয়া।
ডানপন্থী বামপন্থী সব দলের গোমর ফাঁস। জ্যাক শিাখ মস্ত টাকা ঘুষ নিয়েছে দলের জন্য, সে জানো?
জসপার দলে যে চোর নেই তা না।
হোসে বোভে যে হারে জনপ্রিয় হচ্ছে, নির্বাচনে দাঁড়ালে ঠিকই পাশ করে যাবে।
আরে ধুর, এ সব হুজুগ। নিজের ব্যবসার সুবিধে হলে ম্যাগডোনাল্ডস অসুবিধে নয়। দিক না ওরকম সস্তায় খাবার, প্রতিযোগিতার নাম শুনলে বাবুদের মাথায় আকাশে ভেঙে পড়ে।
এক কোণে সানাল আর সুনীল। অনর্গল ফরাসি ভাষায় বকে যাচ্ছে। প্রসঙ্গ ক্রিকেট।
অডিল আর মীনাক্ষী একদিকে। মুলত ওদের বাচ্চাদের গল্প।
নীলা আর চৈতালির সঙ্গে যোগ হল সাহানা।
প্রসঙ্গ সংসার। নতুন সংসার। বাজার সদাই। কোথায় কোন দোকানে পাঁচফোড়নের মশলা পাওয়া যায়, দেশি মাছ কোন দোকানে ভাল। তারপর কী রাঁধতে গিয়ে কী দিলে স্বাদ হয় ভাল।
কিষানের দলে রাজনীতি সরিয়ে ঢুকল ব্যবসাপাতি।
মুরগিতে সালমোনেলা, পাগল গোরু রোগ!
যত্তসব প্রচার।
মাছ মাংসের ঢালাও আমদানি হচ্ছে, দেশি মাংসের চড়া দাম।
ধুত, এদেশে ভারতীয় রেস্তোরাঁ করে লাভ নেই, রেস্তোরাঁর ব্যবসা চলে ইংলন্ডে। অবাধ অনুপ্রবেশকারীগুলো দল বেঁধে ইতালি চলে যাচ্ছে, কাজ করাব কাকে দিয়ে। কিষান বলে। তারপর নীলার দিকে তাকিয়ে, এক চোখ ছোট করে, বউকেই নামিয়ে দেব ব্যবসায়, ও রাঁধবে, আমি বাড়ব।
কী কেমন রাঁধো তুমি? কিষান কনুই ঠেলে নীলার পেটে।
আমি রাঁধতে জানি না। নীলা নিজের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বলল।
কিষান জোরে হেসে উঠে। বলে কী মেয়ে, মেয়ে হয়েছ, রাঁধতে জানো না?
আমার রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখো, জীবনে যে ছেলেগুলো দেশের রান্নাঘরে উঁকি অব্দি দেয়নি, তারা কী দিব্যি রাঁধছে। তোমারও হয়ে যাবে।
সুনীল ক্রিকেট প্রসঙ্গ স্থগিত রেখে বলে, এই এই এই নতুন বউকে এক্ষুনি রান্নাবান্নার কথা বলছেন, আরে যাক না কটা দিন।
.
অনেক তো প্যাঁচাল হল, চৈতালি আপনি একটা গান করুন। চৈতালির হাতে চাপ দিয়ে বলে নীলা।
গান? ওরে বাপ। গান হল বাঙালির আড্ডায়। অবাঙালিরা গানের বোঝে কী! যত্তসব বেরসিক।
চৈতালি বাংলায় বলে। অবাঙালির দল থেকে কারও তেড়ে আসার তাই লক্ষণ নেই।
রাত আটটায় এক কালো সুট নেকটাই ঢুকল। হাতে খাবারের প্যাকেট। কিষানের রেস্তোরাঁর খাবার। রুটি সবজি। কিষানলাল নিরামিষাশী। এ বাড়িতে মাছ মাংস চলে না।
টেবিলে খাবার রেখে কালোসুট নেকটাই মোজাম্মেল বউ দেখতে এল কিষানের। মুখে এক গাল হাসি। চোখ এমন যে মনে হয় কাজল পরে আছে।
দিদি, আমি কিষানবাবুর দোকানে কাজ করি। বাংলাদেশের ছেলে।
বাঙালি!
নীলার দু চোখে দু ফোঁটা আনন্দ।
চৈতালি টেবিল সাজিয়ে দেয়, কেউ বসে টেবিলে, কেউ সোফায়।
সুনীল খেতে খেতে বলে, মাছ ভাত খেতে ইচ্ছে হলে আমাদের বাড়ি চলে এসো নীলা। চৈতালি চমৎকার রান্না করে।
নীলা বলে, আমার তো এক্ষুনি লোভ হচ্ছে খেতে। রুটি সবজি একদিন খাওয়া যায়, দুদিন না।
মোজাম্মেল তার হাসি মুখে নিয়ে বলে ওঠে, কোনও চিন্তা নেই দিদি, তাজমহলে চলে আসবেন। মাছ মাংস বেশ ভাল রাঁধে আমাদের বাবুর্চি।
খাবার পরও আড্ডা গড়ায় অনেকক্ষণ। কিষান নতুন বোতল খুলেছে। বাড়িতে সিজোফ্রেনিক ছেলে রেখে এসেছে বলে তারিকদম্পতি আগে ভাগে চলে যায়। রাজেশ দম্পতিও। সুনীলদম্পতি তাদের টুম্পামণিকে সানদানিতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে এসেছে, ও বাড়িতে ঘুমোবে সে। ওদের তাই তাড়া নেই ওঠার। বোতল খালি হলে সানাল ওঠে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হুকে ঝুলিয়ে রাখা গরম জ্যাকেট পরতে পরতে সানাল সবাইকে শুনিয়ে বলে, নীলাবউদি, যাবার সময় দু গালে চুমু দিতে হয় এদেশে। আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে দিচ্ছি না। আজ যত ইচ্ছে চুমু খাবার দায়িত্ব কিষানকে দিয়ে গেলাম। ওর প্রাপ্য। কী বলো কিষান।