কেন আমি মুসলিম নই! সুনীলের ঝটপট জবাব।
হ্যাঁ, কেন আমি মুসলিম নই।
নীলা বলে, বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো! কেন আমি ক্রিশ্চান নই। আচ্ছা, কেউ কোনও বই লিখেছে, কেন আমি হিন্দু নই?
চৈতালি ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ে ধীরে। না তার জানা মতে নেই।
সুনীল মগ্ন ছিল হুইস্কির গুণাগুণ বর্ণনায়, মগ্নতা থেকে মুহূর্ত ব্যয় করে বলল, হ্যাঁ লিখেছে, শ্রীসুনীল চক্রবর্তী।
হা হা।
কিষান, কী খাওয়াচ্ছ এ সব! মল্ট বের করো। মল্ট।
কিষান সুনীলের আবদার পালন করে মদের তাক থেকে এক হাতে গ্ল্যানফিডিশ, আরেক হাতে লাফ্রোওইগ নিয়ে দুলতে দুলতে আসে।
আসরে তুমুল আনন্দধ্বনি।
শেষটা হবে স্প্রিংব্যাঙ্ক দিয়ে।
ওয়াও হো। সানাল সিটি বাজায়।
ইংরেজি ফরাসি হিন্দি মিশিয়ে আড্ডা জমে ওঠে। প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ করে গলার স্বর সপ্তমে ওঠে সবার। সোফার এক কোণে চৈতালির গা ঘেঁষে বসে থাকে নীলা, বউ নীলা, মুখে রং মাখা নীলা, পুতুল নীলা, অতিথি নীলা। আড্ডার লোকেরা উঠে উঠে রান্নাঘর থেকে নিজেরাই জল বা বরফ বা কমলার রস নিয়ে আসে। কমলার রস নীলার আর সাহানার গেলাসে। বাকিরা হুইস্কির সঙ্গে কেউ নেয় জল, কেউ নেয় বরফ। তারিক জল বা বরফ না মিশিয়ে খায়। খেতে খেতে অন্তত দুবার বলে ফেলেছে, হুইস্কিতে জল মেশালে এর স্বাদই নষ্ট হয়ে যায়। এই মুশকিল ভারতীয়দের, মদ খেতে জানে না, তবু খাবে।
রাজেশ বলে, আমরা কি ভাই মদ খাওয়ার জন্য মদ খাই! খাই মাতাল হবার জন্য। তা যেভাবে মাতাল হওয়া যায়।
তা বলেছ বটে ভাই! বাবু গোগিনি গলা ফাটিয়ে হাসে।
সাহানা বাবুকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলে, অমন দৈত্যের মতো হাসছ কেন? এর মধ্যে মাতাল হয়ে গেলে নাকি।
সানাল খপ করে ধরে সাহানাকে, আচ্ছা, এই যে বললেন দৈত্যের মতে, দৈত্যকে কখনও হাসতে দেখেছেন?
দেখেছি দেখেছি, অডিল মুখ খোলে, লা জকোন্দাকে হাসতে দেখেছি।
হাসির রোল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যে হাসিটি এঁকে লা জকোন্দাকে জগৎবিখ্যাত করেছেন, সেটিকে এক বাক্যে দানবীয় বলে রায় দেওয়ার পর, নীলার জানতে ইচ্ছে হয়, এ কি লোক হাসাতে, নাকি অডিল আসলেই মনে করছে হাসিটি অমন? জানার ইচ্ছেটি নীলা প্রকাশ করার সুযোগ পায় না কারণ সানাল আবার লাফিয়ে এসেছে নীলার দিকে। তিন চারটে হাঁটু ডিঙিয়ে।
গেলাসে, যেখানে কমলার রস ছিল, খানিকটা ভদকা ঢেলে দুটো ঝাঁকানি দিয়ে সানাল গম্ভীর মুখে বলল, এই স্ক্রু ড্রাইভারটা লক্ষ্মী মেয়ের মতো গিলে ফেলো তো নতুন বউ, তোমার মাথার যে সব স্ক্রু ঢিলে আছে, কাল সকালের মধ্যে সব টাইট হয়ে যাবে।
আরও এক দফা হাসি। হাসলে কিষানের কোদালি দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে। আর বাবু গোগিনির সোনা হাসি, ওপরের পাটির দুটো দাঁত সোনায় বাঁধানো, দুটো ঝলকায়। তারিক ইসমাইল ঠোঁট টিপে হাসে, হাসলে মাথা থেকে পা অব্দি কাঁপে। চৈতালি হাসি চাপলেই বাঁ হাতে মুখ ঢাকে। সানাল হাসে হা হা হো হো করে। আর অডিলের হাসিতে কেবল ওপরের গোলাপি মাড়ি বেরোয়, না দাঁত না শব্দ। রাজেশের মুখ ভর্তি দাড়ি, গোঁফ নেমে এসেছে ঠোঁটের ওপর, হাসলে গাল প্রসারিত হয়, এ পর্যন্তই, দাঁত ঢাকা পড়ে যায় গোঁফের আড়ালে। সুনীল হাসে দম টেনে, বাতাস বেরোয় না, ঢোকে।
ওই দমকের মধ্যে বাবু গোগিনির শখ হয় একটি প্রশ্ন করতে সবাইকে।
প্রশ্নটি হল, কেন ফরাসি পুরুষদের মুখ এত বড়, আর হাত এত ছোট?
কেউ জানে না এর উত্তর।
বাবু গোগিনি গম্ভীর মুখে উত্তর বলল, কারণ ফরাসি মেয়েদের স্তন খুব ছোট, আর স্তনবৃন্ত খুব বড়।
অডিল আর সানাল ছাড়া আর কেউ হাসল না।
মীনাক্ষী মুখ ঘোরাল।
সাহানা উঠে গেল।
প্রশ্নে প্রশ্ন বাড়ায়, সানাল বলে, আইন কী লিঙ্গ বলুন তো?
উত্তর নেই কারও মুখে।
উত্তর বলে দেয় সানাল, স্ত্রীলিঙ্গ।
উত্তর বলে দিব্যি মুখ বুজে বসে থাকে যতক্ষণ না এর কারণ জানার কৌতূহল কারও হয়। অডিলের হয়।
আইন স্ত্রীলিঙ্গ, কারণ আইনের ফাঁক আছে।
চৈতালি জিজ্ঞেস করে, কারও কি কমলার রস টস লাগবে?
প্রসঙ্গ দ্রুত ঘোরানো হচ্ছে।
আজ তোমার ছুটি, কাল থেকে সংসারধর্মে নেমে পড়তে হবে, বুঝলে। নীলার দিকে হাসিমাখা একখানা বাণী ছুঁড়ে দেয় কিষান।
সেই বাণীতে নীলা খুব বিদ্ধ বা রক্তিম হয় না।
চৈতালি নাক গলায়, সংসার কি আর একজনের, সংসারধর্মে নামতে হলে দুজনকেই নামতে হবে।
কিষান এক চুমুকে গেলাসের তলানিটুকু গিলে বলল, আমি অবিশ্বাসী লোক। আমার দ্বারা ধর্ম টর্ম পোষাবে না।
আর আমার বুঝি পোষাবে? নীলা প্রশ্ন করে।
তোমার পোষাতেই হবে। তুমি মেয়ে।
আসরের সবাই হেসে ওঠে, বড় জব্দ করা গেছে লেখাপড়া জানা মেয়েকে।
আরে কাছে এসে বসো না, বউ হয়ে এত দূরে দূরে থাকলে চলে! ঢুলু চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে কিষান বলে।
আসরের সবাই প্রায় ঠেলে পাঠায় নীলাকে কিষানের পাশে।
কিষান গেলাসে চামচের টোকা দিয়ে সবার চোখ ওর দিকে ফিরিয়ে বলে, ভদ্রমহাশয় ভদ্রমহিলাগণ, আমার বউখানা বেশ সুন্দরী! ঠিক কি না?
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। সমস্বরে রব ওঠে।
নীলার পিঠে বাহ বাহ বা জাতীয় চাপড় মেরে বলে কিষান, আরে দেখতে হবে তো কার বউ!
কিষানের এমন একটা বউয়ের দরকার ছিল বড়। তারিকের মত।
এমন কেমন?
এমন লক্ষ্মী, এমন সুন্দরী। আগাগোড়া ভারতীয়। ফিরিঙ্গিদের দিয়ে কি আর পোষায়! এদের সঙ্গে প্রেম করা যায়, বিয়ে করা যায় না। বিয়ে করলে ভাই ভারতীয়। তারিক বিশুদ্ধ হিন্দিতে বলে।