.
খিদে সামাল দিতে দু চাক রুটি খেয়ে, জল খেয়ে দু গেলাস, চৈতালির তাড়ায় গরম জলে স্নান করে নেয় নীলা। স্নানের জলে ধুয়ে যায় সিঁথির সিঁদুর। ধুয়ে যায় চোখের কালো কালি। নিজেকে শুদ্ধ স্নিগ্ধ করে ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে, যেই না জানালায় দাঁড়িয়েছে, আকাশ বা আকাশের নীচে যে স্বর্গ, দেখতে, হই হই করে ওঠে কিষান, বউ হয়ে এ কী পোশাক পরেছ? শাড়ি পরো, গয়না পরো, সন্ধেয় লোক আসবে বউ দেখতে।
কিষানের আবদার বা আদেশ মতো নীলা জিনস ছেড়ে লাল একখানা কাতান পরে সোনার অলংকারে গা মুড়োলো, হাত ভরে সোনার চুড়ি, কানে ভারী ঝুমকা, গলায় সোনার মালা। মুখে পাউডার মেখে কাজল পরে, সিঁদুরের টিপ পরে কপালে, সিঁথিতে সিঁদুরে আঙুল টেনে এয়োতির চিহ্ন এঁকে, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক লাগিয়ে তাকাল নিজের দিকে। এ সিঁদুর তো সুশান্তর পরিয়ে দেবার কথা ছিল। নীলার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো তেতো হাসি, কোথায় এখন সুশান্ত! দিব্যি আছে নিশ্চয়। বছর ধরে প্রেম করল নীলার সঙ্গে, আজ বিয়ে হয়, কাল বিয়ে হয় এমন, শেষ অব্দি জাতে মেলে না বলে কেটে পড়ল, কুলীন ব্রাহ্মণের ছেলে সুশান্ত চক্রবর্তী, নমশুদ্রের মেয়ে নীলাঞ্জনা মণ্ডলের সঙ্গে প্রেম করতে পারে, কিন্তু বিয়ে নৈব নৈব চ। লেখাপড়া জানা ছেলেও যে এত জাতফাতের তোয়াক্কা করে! তোয়াক্কা সম্ভবত সুশান্ত করেনি, করেছে ওর বাবা মা, আর প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেই বা কী করে বাপ মায়ের পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গে সাত পাকে ঘোরে, নিজের পছন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে! নীলার কাছে ও সব কেবল অবাক করা ব্যাপার নয়। নিজের জীবনটিও তাকে অবাক করে, বিশেষ করে জেদ করে বিয়ে করার ব্যাপারটি। জীবনে আর যে দুর্ঘটনা ঘটুক এটি যে ঘটবে না, এ ব্যাপারে অনেকটাই সে নিশ্চিত ছিল। সুশান্তর বিয়ের পর, স্মৃতির ধার, দাঁতের কামড় নীলাকে রক্তাক্ত করছিল প্রতিদিন, এ ছাড়া, সে ভাবে, তার উপায়ই বা কী ছিল! নীলার হঠাৎ মনে হয়, বাঁচার জন্য কি তার কলকাতা ছাড়া, না কি এ অন্য রকম এক মৃত্যুকে বেছে নেওয়া, অথবা বিয়ে করতে হয় বলে করা, না করলে লোকে মন্দ বলে, ভুরু কুঁচকে তাকায়, তাই! নাকি কী ব্যাপার, বয়স এত হয়ে গেল, এখনও পাত্র জুটল না। এসব কূটকথা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সে যে কালা নয়, খোঁড়া নয়, তারও যে পাত্র জুটতে পারে, তা কিষানকে বিয়ে করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর পাড়াপড়শিকে দেখিয়ে এল। তাই কি?
.
সন্ধেয় বাড়িতে সাতজন অতিথি এল। সাতজনের মধ্যে দুজন অবাঙালি ভারতীয়, একজন ফরাসি। অডিল। গুজরাটি তারিক ইসমাইলের বউ। বউ নিয়ে এসেছে দুজন, বাবু গোগিনি আর রাজেশ শর্মা। বউ ছাড়া সানাল এডামারুকু। ওর বউ নেই। নীলা গ্রহণ করল যে যা দিল, মীনাক্ষীর সাতরঙের ফুলের তোড়া, সাহানা গোগিনির শাড়ি, আর সানালের একটি, একটিই টকটকে লাল গোলাপ আর দুগালে অডিলের চু চু করে দুটো চুমু। যে যার মতো চেয়ার টেনে বসে গেল। সবাই এ বাড়িতে আগে এসেছে। নীলাই নবাগত। অতিথিরও অতিথি।
মোয়েট অ্যান্ড শানডন শ্যাম্পেনের বোতলের গলা ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কিষান বলল, আমার একটি নয়, দুটি নয়, একটি মাত্র বউ। আজ না হয় ভাসলামই শ্যাম্পেনের জলে। বলে যেই না বুড়োআঙুলে ছিপির গোড়ায় চাপ দিয়েছে, ছিপি বিষম শব্দে ছাদে লাফ দিল, আর শ্যাম্পেন ফুঁসে উঠে ফোয়ারার মতো ছড়িয়ে পড়ল নীলার গায়ে। যেটুকু বোতলে ছিল। তাই ঢেলে গেলাসে গেলাসে ঢেলে দিল কিষান।
গেলাস উঠিয়ে ফ্রান্সে স্বাগতম বলল বাবু গোগিনি। বাকিরা সঙ্গে সঙ্গে যার যার গেলাস উঠিয়ে পাশের গেলাসে টুং টাং শব্দ তুলে একই কথা বলল, স্বাগতম। মাতামাতি কিছুক্ষণ নীলাকে নিয়ে চলল, আহা সে কী ডাগর চোখ। চোখ তো দেখে না, যেন কথা বলে। সাহানা বাঁ কাতে নীলাকে দেখে বাবুকে খোঁচায়, দেখো দেখো ওকে একটু রেখা রেখা লাগে না? গোগিনি দম্পতির ধারালো চোখের সামনে তখন নীলা, জবুথবু নীলা, বাবু ঘাড় ডানে কাত করে ফিসফিস করে, আরে না, খানিকটা মীনাক্ষী শেষাদ্রির মতো বলতে পারো।
উঁহু, সানাল লাফিয়ে তিন চারটে হাঁটু ডিঙিয়ে নীলার সামনে লাল গালিচায় আসন করে বসে নাহ, কে বলে রেখার মতো, মীনাক্ষীর মতো, আমাদের বউদি দেখতে, যতটা গম্ভীর হওয়া সম্ভব, হয়ে, বলে একেবারে নীলাঞ্জনা মণ্ডলের মতো।
সারা ঘর হেসে ওঠে।
সানাল পদার্থবিদ। দশ বছর এ দেশে, বিয়ে থা করেনি। নোয়াজি-তে বাড়ি কিনেছে। একা থাকে। ছ ফুট মতো লম্বা। মেদহীন শরীর। ঘাড় অব্দি লম্বা চুল। মাথা নেড়ে যখন কথা বলে সানাল, সামনে পেছনে দোল খায় তার চুল। একবার সানালকে দেখে, আরেকবার কিষানকে, নীলা মেলায়। সানালকে দেয় একশোয় পঁচাশি, আর কিষানকে পনেরো। সানালের সঙ্গে, নীলা ভাবে, যে তার তো বিয়ে হতে পারত। কিন্তু হয়নি। জীবন যে কোথায় কার সঙ্গে বাঁধা থাকে! আসলেই কি বাঁধা থাকে? সুনীল যদি সানাল এডামারুকুকে কলকাতায় পাঠাত বিয়ে করতে, তবেই তো জীবন অন্যরকম হতে পারত তার। হতে পারত কিন্তু হয়নি।
ওই লোকটি, ওই ফরাসি মেয়েটির স্বামী? উনি কী করেন? নীলা চৈতালির কানে কানে জিজ্ঞেস করে।
লেখেন। থাকতেন লন্ডনে। ফরাসি মেয়ে বিয়ে করে এ দেশে চলে এসেছেন। বেশ ভাল একটা বই লিখেছেন জানো তো। কী নাম যেন বইটির…চৈতালি তার হাতের বুড়ো আর মধ্যমা ঘষে মনে করার চেষ্টা কার কী নাম, কী নাম…এই সুনীল তারিকের বইটির নাম যেন কী?