বাদ দাও মা, বাঙালি তো যথেষ্ট দেখা হল। দেখা হল না? নীলা গলায় কান্না চেপে বলেছিল।
ওই দু সপ্তাহই। ওর মধ্যে পাসপোর্ট ভিসা টিকিট এ সবের ব্যবস্থা করে, দিল্লি হয়ে প্যারিস চলে এল কিষান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের পরীক্ষা শেষ হতে কিছু বাকি ছিল নীলার, শেষ করে, সেও আকাশে উড়বে, এমনই কথা। স্বামীকে তুষ্ট করার জন্য নীলার বাবা অনির্বাণ তাগাদা দিয়েছেন বিয়ের শাড়ি অলংকার পরে উড়োজাহাজে উঠতে, সম্ভবত পুরুষই ভাল জানে, পুরুষেরা কীসে তুষ্ট হয়। কিষানই এই জগৎ সংসারে তার সবচেয়ে আপন, যেহেতু সে স্বামী, স্বামীর সঙ্গে বাকি জীবন যাপন করতে হবে তার, স্বামীকে তুষ্ট করতে হবে জীবনভর, তবু কী ব্যাপার রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছ ছাড়া আর কিছু প্রশ্নের হ্যাঁ না উত্তর ছাড়া স্বামীর সঙ্গে মধুর কোনও বাক্যালাপ তো নয়ই, কোনও মিষ্টি হাসি বা দৃষ্টি বিনিময়, তাও হয় না। কথার ফুলঝুরি যা কিছু সব বাংলায়, যা বলে পেছন ফিরে।
আচ্ছা, বিমানবন্দরের ফরাসি লোকগুলো ইংরেজি জানে না নাকি! ভাল ইংরেজি বলল না তো!
জানে জানে। ইচ্ছে করে বলে না। এই তো সবে এলে, থাকো, দেখবে এদের বর্ণবাদী চরিত্র। চৈতালির চিকন গলা ভারী শোনায়।
কী ব্যাপার, এত চুপচাপ যে। কিষানের মাথায় চাঁটি মেরে বলে সুনীল।
কিষান, মোটা কালো মোচ, আঙুলে পাকাতে পাকাতে মুখ খোলে, বাঙালি বেচারাকে একটু সুযোগ দিচ্ছি কিচিরমিচির করার।
হা হা।
.
নীলার ক্লান্তি জলতেষ্টা খিদে মাথাধরা উবে যায় যখন প্যারিস শহরের ভেতর ঢোকে গাড়ি। নীল পোশাকের কমবয়সি, বেশিবয়সি, চুইংগাম, গজদন্তের ওপর যে অভিমান ছিল, মুহূর্তে জল হয়ে গেল। গাড়ি হোটেল দ্য ভিল ছাড়িয়ে প্যালে রয়াল ছাড়িয়ে লুভর জাদুঘরের ভেতর দিয়ে পঁ নফের ওপর দিয়ে, সেইনের পাড় ধরে বুলোভার্ড শাঁ মিশেলের। দিকে যাচ্ছে যখন নীলা নিজেকে জিজ্ঞেস করে, এর নাম কি স্বর্গ? নিজেকেই উত্তর দেয়, এর নামই।
.
অতিথি বধূ
কিষানলালের বাড়িতে পা দিয়ে নিজেকে অতিথি-মতো লাগে নীলার। বিশাল বাড়ি, দেয়ালের মাথা থেকে মেঝে অব্দি জানালা, জানালায় ভারী পর্দা, ওপারে ফুলে ছাওয়া ঝুল বারান্দা। আকাশ রঙের নীল গালিচায় ছাওয়া মেঝে, সোফায় বসতেই নরম গদিতে পা ডুবে যায় নীলার, সামনে মদের বোতলের তাক, পাথরের নারীমূর্তি, ছাদ থেকে পাখার বদলে ঝুলছে কাচের ঝালরবাতি, দেয়ালে সাঁটা ইস্পাতের পাত উত্তাপ ছড়াচ্ছে ঘরময়। চৈতালির তাড়ায় নীলাকে বাড়ি দেখতে উঠতে হয়, এই হল বসার, এই শোবার, আর ওপাশের ঘরটি ঠিক কোনও কাজের নয়, বাড়তি মানুষ বা অকেজো জিনিসপত্র গোঁজার, আর এদিকে রান্নাঘর, ওদিকে স্নানঘর, কলঘর, মলঘর। সংসার নতুন করে সাজাবার কিছু নেই, চৈতালি বলে। এই দেখো ধুলো ঝাড়ার, কাপড় ধোবার, শুকোবার, বাসন ধোবার, এমনকী ডিম ফাটাবার, ফাটিয়ে একে নাড়বার, সেদ্ধ করবার, ফালি ফালি করে কাটবার যন্ত্র। সুশান্তর সঙ্গে টোনাটুনির সংসার করার স্বপ্ন দেখত নীলা, প্রথম গাছের তল, তারপর কুঁড়েঘর, সেই নুন আনতে পান্তা ফুরনো ঘরে কুপির আলোয় দুজনে দুজনকে ভালবাসবে, বাইরে বস্তুবাদী জগতের দিকে হো হো হাসি ছুড়ে দেবে আর যেদিন চেষ্টা চরিত্তির করে শহরতলির ইস্কুলে মাস্টারির কাজ জোটাতে পারবে সুশান্ত, যেদিন হ্যাজাকবাতি আসবে ঘরে, সারারাত ধরে উৎসব হবে গানের।
ধুত হ্যাজাকবাতি টাতি না, গানের উৎসব হবে পূর্ণিমায়। খোলা মাঠে।
ভালবাসিয়া গাছের তলে বাস করিব আবেগ নীলার কিছু কম ছিল না। বাঙালি জন্মই নেয় ওই আবেগ নিয়ে। আর সাতাশে পড়তেই কালবোশেখি ঝড়ে জীবন বদলে গেছে নীলার, গুঁড়িসুদ্ধ উড়ে গেছে শখের বটবৃক্ষ, হ্যাজাকবাতি নিবে গেছে, উৎসবে নেমে এসেছে ভুতুড়ে স্তব্ধতা, পূর্ণিমা ঢেকে গেছে এক আকাশ কালো মেঘে, আর নীলাকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে অদ্ভুত বিনাশী হাওয়া সুদূরপারে এক ঝকঝকে ঘরে, সব আছের সংসারে।
কাজের লোক নেই? নীলা জিজ্ঞেস করে।
কিষান আর সুনীল বসে গেছে মদের বোতল খুলে। সে আসরে নিজেকে গলিয়ে দিয়ে চৈতালি বলে, কিষানের বউ কাজের লোকের কথা জিজ্ঞেস করছে গো!
সুনীল সশব্দে হাসে, কিষানের মোচের তলেও হাসি ঝিলিক দেয়।
যে উত্তরটি পায় নীলা, তা হল এই বিদেশে কারও ঘরে কাজের লোক থাকে না, এ দেশে কোনও গরিব নেই যে লোকের বাড়িতে কাজ করবে। আরও একটি ধারণা দেওয়া হয়, আজ যদি কাউকে ঘরদোর পরিষ্কার করার চাকরি দেওয়া হয়, ঘড়ি দেখে এক ঘণ্টায় কম পক্ষে পঞ্চাশ ফ্রাঁ দিতে হবে।
নীলা আঙুলের কড়ায় হিসেব করে চোখ কপালে তোলে, তিনশো টাকা? পুরো মাস চবিবশ ঘণ্টা কাজ করেও তো কলকাতায় বাড়ির কাজের লোকদের তিনশো টাকা দেওয়া হয় না।
সুনীল এবং কিষান দুজনই নীলাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এ প্যারিস, কলকাতা নয়।
লাখ টাকা বেতন দিয়ে কাজের লোক কে রাখে এখানে? মদে বরফ ঢালতে ঢালতে বলে সুনীল।
সব কি নিজের হাতে করতে হবে?
সোফার হাতলে বসে নীলা।
চৈতালির গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে কিষান বলে, ভয় পেলে না কি?
ভয়ের কী আছে। ঘরদোর তো সব গোছানোই দেখছি। ঘরে দৃষ্টি ছড়িয়ে বলে নীলা।
গোছানোর কিছু নেই, তোমার কাজ হল, কোনও কিছু অগোছালো না করা। কিষান জোরে হাসে।