কালো লোকটি তো দিব্যি চলে গেল। আমার দোষটা কোথায় শুনি। নীলা জিজ্ঞেস করে।
আচ্ছা, কোণ থেকেই নীলা প্রশ্ন করল, গোলটা কোথায় হচ্ছে। আমার পাসপোর্টটা কি নকল?
কমবয়সি উত্তর দিল না।
আমার ভিসাটা কি নকল?
কোনও উত্তর নেই।
টাকাগুলো নকল?
কমবয়সি চেঁচিয়ে উঠল, এই লাল শাড়ি, বেশি বকবক কোরো না।
লাল শাড়ি মুখে কুলুপ আঁটে।
যক্ষের ধন যার হাতে, সেই বেশিবয়সি, ফিরে এল। সঙ্গে চুইংগাম চিবোনো আগের লোকাট, লোকটি এখন আর চুইংগাম চিবোচ্ছে না। লোকটির কপালের চোখটিও নিশ্চিহ্ন। নীলার হাতে ছুঁড়ে দেওয়া হল একটি একটি করে ধন, একটি বাড়তি কাগজও পড়ল। কাগজ মানে প্রশ্নপত্র, ইস্কুল কলেজে এমন প্রশ্নপত্র যথেষ্টই হাতে নিয়েছে সে, এ কিছু নতুন ঘটনা নয়। এবার তাকে পাচার হতে হয় কমবয়সি লোকের কাছে।
ভুরু নাচিয়ে কমবয়সি বলে, বেশ তো ছাড়া পেয়ে গেলে। ভাগ্য বলতে হবে। মসিয়ে বেস-এর করুণা না হলে বুঝতে।
কমবয়সির নাকের পাটা আর নাকের তলের মতো ঠোঁটজোড়াও ফোলে। ফোলা ঠোঁট তাকে ওই হোথা যাবার ইঙ্গিত করে। ওই হোথার হদিস পেতে পেতে হাওয়ায় উড়ে যায় আরও সময়। আবার সেই কাচের ঘর, আবার সেই গজদন্ত। গজদন্তের হাতে পূরণ করা বাড়তি কাগজটি বাড়িয়ে দেয় যেখানে অনেকটা মুচলেকা দেওয়া যাহা বলিতেছি সত্য বলিতেছি, মাস পার হইবার আগেই ভালয় ভালয় এই দেশ ত্যাগ করিব। এই দেশে বসত করিবার লোভে কোনও চাতুর্যের আশ্রয় লইব না, লইলে যে শাস্তিই দেওয়া হোক, গা পাতিয়া মন পাতিয়া বরণ করিয়া লইব ইত্যাদি।
গায়ের বাদামি রং, লাল বেনারসি, কপালের আর সিঁথির সিঁদুর, সোনার অলংকার, নীল পাসপোর্ট, খুচরো টাকা প্রাণপণ আড়াল করতে করতে বেড়া ডিঙোয় নীলা। ছাড়পত্র ভিক্ষে পেয়েছে সে, এ ভিক্ষে নাও জুটতে পারত তার। করুণা নাও হতে পারত মসিয়ে বেস-এর। সেই পুরনো কলকাতার পথে আবার একই আকাশ একই মেঘ দেখতে দেখতে ফিরতে হত তাকে একই বাড়িতে, যে বাড়ি থেকে একধরনের চিরবিদায় তাকে দেওয়া হয়েছে। ভিখিরি নীলা একলা পড়ে থাকা দুটো সুটকেস জোগাড় করে যখন বাইরে আসে, সকাল গড়িয়ে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে, শেষ বিকেল।
কিষানলাল তখনও দাঁড়িয়ে, সুনীল আর চৈতালিও। নীলাকে দেখে তিনটি প্রায়-মৃত শরীর প্রায়-দৌড়ে প্রায় নীলার ওপর পড়ে। সুটকেসের ঠেলাগাড়িটি বেঁটে মোটা বুট পরা টাই পরা সুট পরা সুটের ওপরেও কোট পরা কিষানলাল প্রায় কেড়ে ঠেলতে ঠেলতে বলে, কী ব্যাপার, এত দেরি হল কেন? সেই ভোর থেকে বসে আছি!
সুনীল, লম্বা, ফর্সা পাতাকাঠি ঘটকমশাই একগাল হেসে বলে, আমরা প্রায় আশাই ছেড়ে দিচ্ছিলাম।
কপালের থেবড়ে থাকা সিঁদুরের টিপ দুহাতে ঘসে দিতে গিয়ে চৈতালি বলে, আহা কী ধকলটাই না গেছে।
কনকনে ঠাণ্ডার সূচ নীলার হাড়ে কেন মজ্জায় বেঁধে, বন্দর ছাড়তেই। চৈতালি তার গা থেকে বাড়তি গরম কোটটি দিয়ে নীলার গা ঢেকে দেয়। গা পোড়া গরম থেকে আসা নীলা, তীব্র এই সুচগুলোই নীলার প্রতি রোম ছুঁয়ে ছুঁয়ে অমল আনন্দের চাদর বুনে দেয়।
কলকাতায় এই তো আর দু মিনিট দেখেই ফোন করতে নিচ্ছিলাম, পরের ফ্লাইটে ফেরত পাঠাল কিনা জানতে। সুনীলের শুকনো ঠোঁটে ভেজা হাসির টুকরো।
স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর নামের পদবি মেলে না তাই ঝামেলা করেছে। মিললে আর সবার মতো সময়ে বেরোতে পারতাম। নীলা বলে।
পারতে না। পদবি মিললেও ওরা যা করেছে, তাই করত। সুনীল গাড়ির ভেতর গা গলিয়ে দিয়ে বলে।
নীলা গা ছেড়ে দিয়ে সামনের আসনে, বলে, ডলার আরও বেশি থাকলে পারতাম।
সুনীল গলা ছেড়ে প্রথম কেশে নিয়ে তারপর হেসে নিয়ে বলে, পারতে না। এই একই হাঙ্গামা করত ওরা।
হাজার প্রশ্নের চোখ নীলার, পাসপোর্ট ভিসা কিছু তো নকল নয়। কী কারণে করত?
সুনীল হাসে, কিষানও। প্রশ্নটির যেন একটিই মাত্র উত্তর, খ্যাক খ্যাক।
খ্যাক খ্যাকে মন ভরে না নীলার। তা হলে কারণ কী অমন হেনস্থা করার?
কারণ হল তোমার গায়ের রং। যথেষ্ট সাদা নয়। সুনীলের কথা শেষ হওয়ার আগে চৈতালি বলে, আর হল পাসপোর্ট, যথেষ্ট ধনী দেশের নয়।
নিজের গায়ের রং নীলার খুব মন্দ বলে মনে হয় না। সেনেগালির বিচ্ছিরি রঙের সঙ্গে মেলালে সে রীতিমতো সোনার বরণ কন্যা। সোনার বরণ চক্ষু কর্ণ নাসিকা কুঞ্চিত করে সেনেগালির কোমরের হাড় ফোটানো আর জল খাওয়ার নিখুঁত বর্ণনা করে বলে, ও ব্যাটা সে দিব্যি পার পেয়ে গেল।
নীলার কণ্ঠে ক্ষোভের ফুলকি। ক্ষোভ সেনেগালির পার পাওয়ায়।
প্যারিসে নেমে কালো লোক দেখব আশা করিনি। নীলা গাড়ির কাছে নিজের মুখটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে।
কালো দেখলে গা জ্বলে কিযানেরও, সুনীল চৈতালিরও।
যত নষ্টের গোড়া ওই কালোগুলো। বসে বসে সরকারি সাহায্য খায়, সন্ত্রাস করে বেড়ায় আর এদের দোষের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের মতো প্রায়-সাদাদের।
সুনীলই প্রথম উত্তর দেয়, কালো লোকের জ্বালায় বাঁচার উপায় নেই।
কালোদের পিণ্ডি চটকানো চলে অনেকক্ষণ। শুদ্ধ বাংলায়।
.
বাঙালির ভিড়ে অবাঙালি কিষানলাল মাংসের বাটির ভেতর এক টুকরো আলুর মতো পড়ে থাকে।
আলু আড়চোখে মাংস দেখে, লাল টুকটুকে মাংস। নিরামিষাশীর মাংসে লোভ নেই, কে বলে! কিষানের আড়চোখ লক্ষ করে নীলার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় চকিতে সজাগ হয়, রাস্তার সিটি বাজানো যে কোনও কামুক পরপুরুষের সামনে যেমন হয়। খোলা বাহুটি মুহূর্তে আঁচলে ঢাকার পর তার চেতন ফেরে, লোকটি তার স্বামী, স্বামীর সামনে গুটোনোর কিছু নেই। যদিও বিয়ে হওয়ার পর সে দু সপ্তাহ মাত্র শুয়েছে স্বামীর সঙ্গে কলকাতার বাড়িতে, ও কেবল শোয়াই, রাতে সঙ্গম শেষে দুজনই দু দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়েছে। কিষানের সঙ্গে নীলার সম্পর্ক বলতে ওই শারীরিক সম্পর্কটুকুই। ভাঙা হিন্দি আর ভাঙা ইংরেজিতে দু-একটি কাজের কথা ছাড়া নীলার তেমন কোনও কথা হয়নি স্বামীর সঙ্গে। বিয়েতে নীলার মত দেওয়ার আগে মলিনা বলেছিলেন, অবাঙালি ছেলে, জানা নেই শোনা নেই, হুট করে বিয়ে করে ফেলবি, একটু দেখে শুনে কোনও বাঙালির ঘরে..।