সংসার করতে।
কার সঙ্গে?
স্বামীর সঙ্গে।
স্বামীর নাম কী?
কিষানলাল?
বয়স কত?
ঠিক জানি না। আমার চেয়ে বছর দশেকের বড় হবে।
তোমার বয়স কত?
সাতাশ।
কতদিন আছে সে এখানে?
কে?
তোমার স্বামী।
নীলাঞ্জনা ঘাড় চুলকে বলে, সম্ভবত পনেরো বছর।
তুমি সঠিক জানো না?
না।
সে কি এদেশের নাগরিক?
তাই তো শুনেছি।
কী করে সে?
শুনেছি ব্যবসা করে।
শুনেছ? নিশ্চিত নও?
কে বলেছে সে তোমার স্বামী? চুইংগামের ঠোঁটের কোণে ঝিলিক দেয় অবিশ্বাস।
নীলা ডানে বামে তাকিয়ে, বিব্রত বিনীত স্বরে বলে, আমি বলছি। আমাদের বিয়ে হয়েছে এক মাস হল।
পদবিই তো এক নয়। চুইংগামের ঠোঁট থেকে উড়ে অবিশ্বাস এসে বসে ডান চোখে।
তা এক নয়, কারণ…শুকনো ঢোক গেলে নীলা।
কী কারণ?
আমি ইচ্ছে করেই স্বামীর পদবি নিইনি।
নীলার বুক কাঁপে। তার স্বামীদেবতাটি কখনও বলেনি যে পদবি এক না হলে সর্বনাশ। বলেছে নাম ঠিকানা রেখো, বিয়ের কাগজ হাতে রেখো, দরকার নেই যদিও, সাবধানের মার নেই। বৈধ পাসপোর্ট, বৈধ ভিসা, আর কী!
কেউ না চাইতেই নীলা ঝোলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে লম্বা কাগজ বের করে বলে, এই দেখো, আমাদের বিয়ের দলিল।
কার বিয়ের দলিল? ইস্পাতমুখী জিজ্ঞেস করে।
কাগজটি ইস্পাতমুখীর দিকে বাড়িয়ে নীলা বলে, আমার আর কিষানলালের।
কাগজটির দিকে এক নজর তাকায়, হাতে নেয় না, বরং কমবয়সি নেয় ছোঁ মেরে। চুইংগাম লোকটি কমবয়সির সঙ্গে কিছুক্ষণ হড়বড় করে, নিতম্ব দুলোতে দুলোতে, বেরিয়ে যায়, নিতম্বের পেছন পেছন বেশিবয়সি ইস্পাতমুখী। আর কতক্ষণ এই কোনায় বসতে হবে, উত্তরের জন্য সে কমবয়সির দিকে তাকায়। কমবয়সির নিরিন্দ্রিয় ভঙ্গি নীলাকে কোনও আশা বা হতাশার কথা শোনায় না। অতঃপর আবার সেই কোণ, সেই অপেক্ষা, এবার ভ্লাদিমির আলেক্সান্দ্রোভিচের ঝুলে থাকা মাথার তলে। নীলার মনে হয়, এই ইস্পাতের ঘরে ঠায় বসে থেকেই বাকি জীবন কাটবে তার। নিজের অস্তিত্বটি ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, না পারছে ঘর থেকে বেরোতে, না পারছে ঠায় থাকতে। উঠে দাঁড়ায় সে, ঘরময় হাঁটে, দরজায় চোখ, নিস্তার দিতে কেউ আসছে আশায় কমবয়সি ইঙ্গিত করে স্থির হতে। স্থির হয় বটে সে, স্থিরের মধ্যে অস্থিরতা দ্বিগুণ লাফায়। আপাতত এই কোণ থেকে নীলা দূরে সরতে পারলে বাঁচে। সে কলকাতা হলে, কলকাতা।
পা পা করে এগিয়ে এসে, কমবয়সিকে জিজ্ঞেস করে, আমার সুটকেসগুলো কোত্থেকে নেব? কোন বিমানে ফিরতে হবে, এ সবের কি কিছু ঠিক করছেন?
কমবয়সি, কোনও উত্তর দেয় না। যেন এ কোনও প্রশ্ন নয়। অথবা কোনও প্রশ্ন করার অধিকার আর যে কেউ রাখুক, নীলা রাখে না।
আমার স্বামীর আমাকে নিতে আসার কথা। বাইরে অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই। তাকে কি ডাকা যাবে এখানে?
নীলা যার উদ্দেশ্যে বলে, সে একটি কৌটোর মুখ খুব যত্ন করে খুলে, চিমটি দিয়ে কালো তামাকগুঁড়ো তুলে, বাঁ হাতে ওপরের ঠোঁটটি টেনে চিমটির গুঁড়ো গুঁজে দেয় ভেতরে, তার নাকের নীচ থাকে ফুলে, নাকের পাটাও। কোনও শব্দ নেই, কেবল স্তানিস্লাভস্কির নাক ডাকার গড়গড়, আর সেনেগালি কালোর কোমরের মড়মড়। সেনেগালি কালো পিঠ টান করে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ, ক্ষণে ক্ষণে পিঠটিকে ডানে বামে মোচড় দিয়ে মড়মড় করে হাড় ফোঁটাচ্ছে। পিঠের সবগুলো হাড় ফুটিয়ে তবে সে পিঠকে নিস্তার দেয়, সেই সঙ্গে নীলাকেও। সেনেগালি উবু হয়ে আবার সেই নোংরা জলের বোতলে হাত দেয়, আবার হিপোপটেমাসের হাঁ, নিমেষে বোতল খালি।
জলতেষ্টা আর খিদে নীলাকে হাভাতের মতো গিলে খাচ্ছে। বন বন শন শন করে বাতাস নয়, ঘোরে মাথা।
কার কাঁধে মাথাটি রাখবে সে, স্তানিস্লাভস্কির কাঁধই তার কাঁধে এসে পিং পং বলের মতো পড়ছে বারবার, পেচ্ছাপের গন্ধ আরও তীব্র হয়ে নাক বেয়ে মাথায় উঠছে, মাথাটি ঘাড় থেকে আলতো করে তুলে নিয়ে ইচ্ছে করে কোথাও ছুড়ে দিতে। ছুড়লে কোথায় আর, ইস্পাতের দেয়ালেই। কী দরকার ছিল, নীলা ভাবে, কোথাকার কোন কিষানলাল, জানা নেই শোনা নেই, হুট করে তাকে বিয়ে করার! কলকাতা খাঁ খাঁ করছিল, কলকাতা না ছাড়লে নীলা মারা পড়ত। কিন্তু বিয়ে না করেও সে ছাড়তে পারত শহর, দিল্লি বা বোম্বে কোথাও সে চলে যেতে পারত, কোথাও খুব দূরে, সুশান্তর গন্ধ বর্ণ থেকে যোজন যোজন দূরে।
আচ্ছা কেউ কি আমাকে অন্তত এক গেলাস জল দিতে পারো? নীলা নিজেকেই প্রশ্ন করে। নিজেকেই সে উত্তর দেয়, না কেউ আমরা তোমাকে এক গেলাস জল দিতে পারি না।
এমন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বা বসে থাকার অভ্যেস নেই নীলার, বিশেষ করে এ যদি অপেক্ষা হয়। সুশান্তর জন্যও সে এতটা সময় কখনও অপেক্ষা করেনি, আসলে প্রয়োজনও হয়নি, যেখানেই দেখা করার, সুশান্তই গিয়েছে আগে। সুশান্তই। মাথা ঘোরাটা আরও বাড়ে, যেন কেবল মাথা নয়, ভারী একটা বোঝা মাথায় তার, গোটা সুশান্ত তার মাথার ওপর জেঁকে বসছে আবার।
ভারী বোঝার মাথা বেমক্কা চক্কর খেয়ে প্রায় ছিঁড়ে পড়ে, যখন চোখের সামনে সেনেগালিটিকে মুক্তি দেওয়া হয় আর বেগুনি বস্তা কাঁধে নিয়ে পেছনে একটি ঝলক দিয়ে হাসির এবং কাশির, সেনেগালি অদৃশ্য হয়। নীলার হাত নিশপিশ করে আলখাল্লার ঝুল ধরে লোকটিকে হিড়হিড় করে টেনে এনে এই ইস্পাতের ঘরে বসিয়ে দিতে, তারপর নিজে সে অদৃশ্য হতে, কাঁধের চড়ুইটিকে কাঁধে নিয়ে।