বেশিবয়সি আস্ত নপুংসক, প্রসবযন্ত্রণা নেই নাকে চোখে গালে। বদলে ইস্পাতের মুখ, টোকা দিলে হাড় তো ভাঙবেই, আঙুল খসে যাবে, এমন। বেশিবয়সি ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ফরাসি জানো?
না।
কী জানো?
ইংরেজি।
ইংরেজি চলবে না।
মেয়েটি ইস্পাতের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। বিস্ময় তাকে একবার ডানে কাত করে, একবার বামে।
পৃথিবীর কোথাও ইংরেজি ভাষাটি যে অচল হতে পারে, এ তার ধারণায় ছিল না। কলকাতায় জাতে উঠতে হলে বা সভ্য হতে হলে ইংরেজি জানতে হয়। তার বিশ্বাস ছিল, সভ্য লোকেরা, সে যে দেশেরই হোক না কেন, অনর্গল চোস্ত ইংরেজি বলে।
তোমার নিজের ভাষা কী? বেশিবয়সি ধমকে ওঠে।
বাংলা। ক্ষীণ স্বর মেয়েটির।
বাংলা চলবে না, বাক্যটি শোনার জন্য মেয়েটি প্রস্তুত ছিল, মেয়েটিকে হতাশ করে বেশিবয়সি বলে,
দোভাষীর ব্যবস্থা করা হবে।
দোভাষী এলে মেয়েটিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হবে। উত্তর সন্তোষজনক হইলে বিচারকমণ্ডলি রায় ঘোষণা করিবে মুক্তির, আর না হলে অর্ধচন্দ্র, যেখানের মাল সেখানে ফেরত পাঠানো।
ইস্পাত আর প্রসবযন্ত্রণার দু জোড়া চোখ মেয়েটির চুল থেকে পায়ের নখ অব্দি ঘুরে বেড়ায়। কপালের চোখটি সামান্য বুজে ইস্পাতি ইঙ্গিত করে কোণের চেয়ারে। বেনারসি শাড়ি, থেবড়ানো সিঁদুরের টিপ, শুকনো চড়চড়ে ঠোঁট কোণের চেয়ারে গিয়ে বসে। কোণে তিনটে চেয়ার পাতা। তিনটের একটিতে, দেয়ালের লাগোয়াটিতে, কচি কলাপাতা রঙের লম্বা আলখাল্লা পরা ঘোর কালো রঙের এক লোক বসা, লোকটির মাথা ভর্তি চুল নয়, চুলের জট। এক চেয়ারের ব্যবধান রেখে মেয়েটি বসে।
লোকটি জিরাফি গলা বাড়িয়ে খড়খড়ে গলায় বলে, আমি সেনেগালের, তুমি?
মেয়েটি কানে খাটো, কানে খাটো বলে চোখ ইস্পাতের দেয়ালে। দাঁড়কাকের কর্কশ কা কা রব থামার লক্ষণ নেই। তুমি কোন দেশের?
দেয়ালে চোখ স্থির, ঠাণ্ডা গলায় উত্তর ছুঁড়ে দেয় বাতাসে, আমি সেনেগালের নই।
সেনেগালের নয় বলে একটি অহংকারের চড়ুই চকিতে উড়ে এসে তার বাঁ কাঁধে বসে। বাঁ কাঁধটি মেয়েটি মোটে নড়াতে চায় না। কাঁধ না নড়িয়ে আড়চোখে দেখে দাঁড়কাকের কদাকার পায়ের কাছে ততোধিক কদাকার বেগুনি রঙের বস্তা। বস্তাটির গলা খুলে বুনো হস্তিথাবায় একটি নোংরা বোতল বের করে পিঠের দিকে মাথা ঝুলিয়ে হিপোপটেমাসের হাঁয়ের ওপর বোতল উপুড় করে। অর্ধেক বোতল জল ঢুকে যায় হাঁয়ে। জিরাফি গলা মেয়েটির দিকে এল আবার, জল খাবে?
না।
জিরাফি গলা আবার, তোমার পাসপোর্টও কি নকল?
না। এ স্বরটি ঝাঁঝালো।
তুমি কি চিন দেশের?
না।
বুঝেছি, পাকিস্তানি।
মেয়েটি উঠে যায়, কাঁধের চড়ুই কাঁধেই থাকে। দেয়ালে হেলান দিয়ে দেয়ালের দিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। ঘরে আরও এক সাদা লোক ঢুকতেই মেয়েটির চোখ উতলা হয়। সাদা লোকটি সেনেগালির পাশের চেয়ারটিতে বসে। মেয়েটি কাঁধের চড়ুইকে উড়িয়ে দিয়ে সাদার পাশে, জিরাফি নাগালের বাইরে নিশ্চিন্তে এসে বসে। সাদার তেল চিটচিটে কাপড় থেকে পেচ্ছাপের ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে।
সেই গন্ধে স্বচ্ছন্দে নাক ডুবিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি কোন দেশের?
রাশা।
আবার নাক, তোমাকে কী কারণে আটকেছে গো?
লোকটি ফ্যাক করে হলুদ দাঁতে হেসে উত্তর দেয়, মস্কো।
ও তুমি বুঝি মস্কোতে থাকো?
লোকটি মাথা নাড়ে।
জানো আমার এক কাকা মস্কোতে গিয়েছিলেন। খুব নাকি সুন্দর শহর। আমার দাদা তো সামনের বছরই সম্ভবত বেড়াতে যাবে মস্কো।
লোকটি হলুদ দাঁতে হাসে।
পেচ্ছাপের গন্ধে আবার নাক ডোবে মেয়েটির।
আমি ভারত থেকে এসেছি। তুমি গেছ কোনওদিন ভারতে?
লোকটি মাথা নাড়ে।
পেচ্ছাপের গন্ধের দিকে সরে এসে মেয়েটি বলে, বাহ! কোন শহরে গেছ বলো তো! কলকাতা গেছ?
লোকটি উত্তর দেয়, প্যারিস।
ও তুমি প্যারিসে এসেছ আগে? আমার কিন্তু এই প্রথম।
মেয়েটি কোনও উত্তর আশা করেনি, কিন্তু উত্তর উচ্চারিত হয়, মস্কো।
মেয়েটি এবার মুখ বোজে, নাক বোজে। তার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর কী হবে সে অনেকটা অনুমান করে।
প্রশ্ন কতক্ষণ বসে থাকতে হবে কিছু জানো?
উত্তর ভ্লাদিমির আলেকজান্দ্রোভিচ স্তানিস্লাভস্কি।
এদিকে প্রসবযন্ত্রণা আর ইস্পাত মিলে খড়বড় ভড়বড় নড়বড় করে অনর্গল ফরাসি বলে যাচ্ছে। একটি শব্দ বোঝা মেয়েটির পক্ষে সম্ভব হয় না। এক ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট পার হলে কমবয়সি নীল পোশাকের লোকটি তিন আসামির দিকে চেয়ার ঘোরায়। আঙুল তুলে লাল শাড়ির দিকে, স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে, তোমাকে ফিরে যেতে হবে, তোমার দেশে, বুঝলে? কমবয়সির মুখে প্রসবযন্ত্রণা নেই আর, কপালে একটি বাড়তি চোখ ছিল, সেটিও নিশ্চিহ্ন।
মেয়েটি ত্রস্ত উঠে দাঁড়ায়, দোভাষীর কথা বলছিলে, ওর কী হল?
দোভাষী পাওয়া যায়নি।
মেয়েটি যখন অপেক্ষা করছে তার পাসপোর্ট টিকিট ইত্যাদি যক্ষের ধন ফেরত পাবার, নীল পোশাকের বেশিবয়সি ইস্পাতমুখী আরেকটি বেশিবয়সি সাদা নিয়ে ঘরে ঢোকে, এটি চুইংগাম চিবোচ্ছে। এটি নীলার মাথা থেকে পা অব্দি নিরীক্ষণ করে, দুচোখে কুলোয় না, কপালে একটি বাড়তি চোখ ছিল, সেটি খোলা।
চুইংগাম চিবোত চিবোতে, মেয়েটিকে, কী নাম?
কার?
তোমার।
নীলাঞ্জনা মণ্ডল।
প্যারিসে কী কারণে এসেছ?