নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তা ঠিক চা তো সে খেয়েই এসেছে, এক কাপ নয়, দু কাপ।
নীলার ব্যাকুল বায়না স্বচ্ছন্দে নাকচ করে দেয় কিষান। স্ত্রীলোকের এ ধরনের বিনতি মিনতিকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়, এ শিক্ষা কিষান তার ছ বছর বয়সেই নাকি পেয়েছে। কিষান বলেও, অবশ্য হেসে গড়িয়ে, তার মায়ের একবার শখ হয়েছিল পাকা আম খাবে, সে আম পাড়তে গিয়ে গাছের মগডাল থেকে পড়ে পা ভেঙেছিলেন কিষানের বাবা, সেই থেকে কিষানের বাবা ছেলেদের ডেকে সাবধান করে দিয়েছেন, স্ত্রীলোকের আবদারে কান দিবি তো মরবি।
গাড়ি চোখের নিমেষে সেইন পার হয়ে যায়। শাতলের মিনিপ্রিতে ঢুকে নীলার বিস্ময় কাটে না। থরে থরে সাজানো খাবার দাবার। রান্না করা ভাত, এমনকী রান্না করা মাছ মাংস সবজি রঙিন রঙিন প্যাকেটে পোরা। বাড়ি নিয়ে গিয়ে গরম করে খেয়ে নিলেই রান্নার ঝামেলা যায়। বোতলে সিমের বিচি আর ভেড়ার মাংস রান্না করে রাখা, খাবারের নাম কাসুলে।
নীলা বলে, এরা কি রান্নাবান্না করে না? প্যাকেটের বোতলের খাবার কিনে খায়!
রান্না করে সময় নষ্ট করতে কেউ চায় না। কিষান বলে।
কৌটোর জলে মটরশুঁটি, ঢেঁড়শ, গাজর, টম্যাটো ভেজানো। ন বছর পার হলেও এগুলো তাজাই থাকবে জলে। মাছ মাংসের ঝোলের পাউডার করে রাখা প্যাকেটে, বছর কয় গেলেও ক্ষতি নেই, জলে গুলে ঝোল বানিয়ে নিতে পারে। এমনকী আল সেদ্ধরও পাউডার। নীলা হতবুদ্ধি দাঁড়িয়ে থাকে।
ওটা কি সবুজ সবুজ, বোতলে?
জলপাই।
জলপাই? না জলপাইয়ের বাচ্চা!
সবজির এলাকায় এসে সে জিজ্ঞেস করে, পুঁইশাক নেই? ওটি আমার খুব পছন্দ।
দেশি শাক পাবে না।
লাউ কুমড়ো?
পাগল!
আচ্ছা এদের সবজি আনাজ সব এত বড় বড় কেন!
সব কৃত্রিম উপায়ে বানানো।
পাঁচটা ধনেপাতার ডাল একটি ঝলমলে প্যাকেটে পোরা দেখে নীলা লাফিয়ে ওঠে, বাহ কী চমৎকার দেখো দিকিনি। ধনেপাতা আমার খুব পছন্দ…
আরে তোমাকে কিলো কিলো ধনেপাতা এনে দেব চিনাদের দোকান থেকে। বারো ফ্রাঁ রাখছে, পাঁচটা ধনেপাতার জন্য…এগারো ফ্রাঁই প্যাকেটটির জন্য রেখেছে।
নীলা রেখে দেয় প্যাকেট, যেখানে ছিল।
চাপাতা?
ঠিক আছে চাপাতা নাও। তবে কি জানো, চায়ের নেশা বড় খারাপ নেশা।
পাঁচশো রকম পনির। সবচেয়ে দামি পনিরটি নাকের কাছে ধরে সুগন্ধ নিতে গেলেই নীলার বমি উঠে আসে, পেট থেকে গলায়। গলায় বমি আটকে নাক চোখ বন্ধ করে সে পনিরের এলাকা থেকে নিজেকে ত্বরিতে সরিয়ে নিয়ে, মাছ মাংসের এলাকায় গিয়ে শ্বাস নেয়, চোখ খোলে। টুকরো টুকরো মাংস প্যাকেটে সাজানো। ভেড়া, মুরগি, বড় মুরগি, হাঁস, খরগোশ, গোরু, শুকর। সবচেয়ে দামি মাংস গোরুর, সবচেয়ে কম দাম মুরগির। কলকাতায় সবচেয়ে সস্তা গোরু, আর চড়া দাম মুরগির। হাড় নেই কেন মাংসে? হাড়ের মাংসেই তো স্বাদ বেশি। এরা হাড় ছাড়িয়ে, তেল ছাড়িয়ে মাংস খায়। ঘটে বুদ্ধি থাকলে লোকে নাকি তাই করে। মাংসেরও ছোট জাত বড় জাত আছে, বুকের মাংস বড় জাত, দামি, পায়ের মাংস ছোট জাত, তাই দামেও কম।
কাঁটা ছাড়িয়ে আঁশ ছাড়িয়ে নানারকম মাছ রাখা প্যাকেটে।
গোলাপি সালমনের দিকে আঙুল তুলে নীলা বলে, এটি কী করে রাঁধে?
কাঁচা খায়।
আর চিংড়ি?
এও কাঁচা খায়।
নীলা ওয়াক করে। ওয়াক করেও ঘুরে ঘুরে বাজার তো নয়, জমকালো দোকানটিতে হাঁটে সে। হাজার রকম চকলেটে ছেয়ে আছে তাক, হাজার রকম ওয়াইনে। চোখ জুড়িয়ে যায়, মনও।
প্যাকেটের খাবারের ওপর কৌতূহল বাড়ে নীলার। একটি ঝলমলে প্যাকেট হাতে তুলে নিতেই কিষান বলে, করো কী করো কী এ তো কুকুরের খাবার!
আরেকটি কৌটো হাতে নিয়েও ঝামেলায় পড়ে। কিষান হাত থেকে কৌটোটি নিয়ে তাকে রেখে দিয়ে গলা চেপে বলে, বেড়ালের খাবারে হাত দিচ্ছ কেন? ঘরে কি বেড়াল পোষো?
নীলা বোকা বনে যায়। কুকুর বেড়ালের জন্য দোকানে খাবার কিনতে পাওয়া যায়, তাও আবার মানুষের খাবারের পাশেই সে খাবার রাখা, মানুষের খাবারের প্যাকেটের মতোই প্যাকেটে, কৌটোর মতোই কৌটোয়। কলকাতার বাজারে নীলা অনেক গেছে, ধুলো কাদায়, চিৎকারে গ্যাঞ্জামে পচা মাছের বাসি খাবারের নোংরা নর্দমার গন্ধে নীল ডুমো মাছি ভনভনে দাঁড়িয়ে নেড়িকুকুরের ঘাঅলা গায়ে লাথি কষিয়ে দূরে সরিয়ে, মানুষের বগলের ঘাড়ের দুর্গন্ধ থেকে নাক বাঁচিয়ে গা বাঁচিয়ে, চেঁচিয়ে দরদাম করে খোলা মাছের মাংসের গা থেকে মাছির উৎসব সরিয়ে, চোর ছ্যাঁচড় সরিয়ে, তবে কিছু কিনতে হয়েছে তাকে।
শাক, সবজি, ময়দা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, দুধ ডিম ইত্যাদি আর দুটো জনি ওয়াকার দোকানের ঠেলাগাড়িতে ভরে, কিষান তাড়া দেয়, চলো চলো। দাম মেটাতে গিয়ে দেখে কিষান কোনও দরাদরিতে গেল না, প্রতিটি দ্রব্যের গা থেকে পড়ে নিয়ে মেশিনই হিসেব করে দিল কত, আর কিষান একখানা নীল কার্ড বাড়িয়ে দিল, মেশিনই সে কার্ডের নম্বর টুকে নিল, মেশিনই কিষানের ব্যাঙ্ক থেকে টাকা জোগাড় করে নেবে। বাহ।
নীলার ইচ্ছে করছিল বাজারটিতেই অন্তত আরও সময় কাটাতে। এ তো আর কলকাতার বাজার নয়। কিন্তু কিষান বাড়ি যাবে। নীলা, যেহেতু সে কিষানের বউ, তাকেও বাড়ি যেতে হয়। বাড়ি ফিরে সে প্যাকেটের বইটি খুলে দেখে, রান্নার বই, মিনা জাফরির লেখা ভারতীয় রান্নায় একটি ইংরেজি বই।