বাচ্চু পেঁয়াজ নাড়তে নাড়তে ধোঁয়া থেকে চোখ সরিয়ে মিষ্টি হেসে বলে দিদি, একদিন আসুন, কিছু রান্না শিখিয়ে যান।
বলে কী, আমিই কি রান্না জানি। আমিই কি গেছি রান্নাঘরে কোনওদিন। এ তো মায়েদের কাজ।
এ সব মায়েদের কাজ। মলিনার কাজ। নীলা এমনই জানে। এমনই সে দেখেছে সারা জীবন যে মলিনা রান্না করে খাবার নিয়ে আসেন টেবিলে, স্বামী সন্তানদের থালে খাবার বেড়ে দেন। স্বামী সন্তান গল্প করতে করতে খায়। মলিনা দাঁড়িয়ে থাকেন টেবিলের পাশে, কারও কিছু যদি লাগে হঠাৎ। নুন বা কিছু। ঝোল বা কিছু। জল বা কিছু। নীলা মনে করতে চেষ্টা করে মলিনাকে কখনও সে খেতে দেখেছে কি না কারও সঙ্গে বসে। না দেখেনি।
.
বাইরে ঝকঝকে রোদ দেখে গরম কাপড়ে গা না মুড়েই রাস্তায় বের হতে চায় নীলা। কিষান টেনে তাকে গরম ঘরে ঢুকিয়ে নবিশ বউটিকে বলে, ও রোদে তাপ নেই। তা যে নেই, তা আপাদমস্তক মোড়া লেপের পুঁটলি হয়ে রোদের তলে দাঁড়াতেই হুল ফোঁটানো ঠাণ্ডা গায়ে কামড় মেরে বোঝায়। মলিনাকে লেখা চিঠিটি ফেলতে নীলা একটি পোস্টাপিস খোঁজে। থিরথির করে থুতনি কাঁপছে তার, খোঁজে। এ শহরে খুঁজতে হয় না কিছু, হাতের কাছেই যেন দাঁড়িয়ে থাকে সব। চোখ মেললেই বস্তু মেলে। পোস্টাপিসে গিয়ে লম্বা লাইন দেখে লাইন না দাঁড়িয়ে সামনে এগোতে গেলেই কিষান অস্থির নীলার গরম জামার ঝুল ধরে টেনে পেছনে এনে কানে মন্ত্র দেয়, এ দেশে যেখানেই যে লাইন দেখবে, শ্রদ্ধা করবে। এ দেশ সমতার দেশ। যে আগে, সে আগে।
নীলা এক পাক নেচে ছোটবেলার খেলার মতো বলে, আগে গেলে বাঘে খায়, মাঝে গেলে নাচে গায়, শেষে গেলে দেশে যায়…
লাইনে দাঁড়াতে হয় না। পোস্টাপিসের ভেতরেই মেশিন বোঝাই। হলুদ একটি মেশিনে চিঠিটি রাখতেই মেশিন বলে দিল, কত টাকার টিকিট লাগবে এতে, টাকা দিলে টিকিট বেরিয়ে এল। সে টিকিট চিঠির গায়ে লাগিয়ে বাক্সে ফেলে দিল, ব্যাস। এক মিনিটের কাজ। কাজ নয় তো জাদু। শহরের মোড়ে মোড়ে ম্যাজিক বাক্স। কার্ড ঢোকালে সুড়সুড় করে টাকা বেরিয়ে আসে, পয়সা ঢাকালে মেশিনের পেট থেকে চা কফি বেরোয়, ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল বের হয়, খেলনা গাড়ি বেরোয়, চকলেট বিস্কুট বেরোয়। আরও ম্যাজিক দেখতে নীলার এবার অনুনাসিক অনুনয়, চলো শহরটা আরও ঘুরে দেখি।
কিষান নীলার জন্য একটি উপহার কিনবে, শহর দেখার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে।
কী সে উপহার?
বলা যাবে না।
ফুরফুরে মন নিয়ে গাড়িতে ওঠে কিষান। মোঁপারনাস থেকে রু দ্য রেনের ভেতর দিয়ে, শাঁ জার্মা দি প্রে বাঁয়ে রেখে, বুলোভার্ড শাঁ জার্মায় যেতে থাকে গাড়ি আর নীলা হাঁ হয়ে দেখতে থাকে ঝকঝকে ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, সিনেমা। ইচ্ছে করে গাড়ি থেকে নেমে আর সব মানুষের মতো সেও হাঁটে, কোনও ক্যাফেতে থেমে আর সব মানুষের মতো বসে চা খায়, চা খায় আর মানুষ দেখে, ঝকঝকে মানুষ, ফুটফুটে মানুষ।
শাঁ মিশেলে গাড়ি রেখে জিবারে ঢোকে কিষান। বইয়ের সমুদ্র। এই সমুদ্রে নীলা ডোবে ভাসে, তল পায় না। এই সমুদ্রের জল তার চেনা নয়। চেনা জলের অন্তত একটি ছোট্ট সরোবর তার আছে, রেখে এসেছে কলকাতার বাড়িতে। বালজাক, ভিক্টর হুগো, গুস্তব ফ্লবের, মোপাসাঁ, আলবেয়ার কাম্যু, জঁ পল সার্ত্রের বইগুলো সে নেড়ে চেড়ে দেখে, বোদেলেয়র দেখে, র্যাঁবো দেখে, পল ভারলেইন, পল এলুয়ার দেখে, এঁদের বাংলা অনুবাদ সে কবেই পড়েছে, মূল ভাষায় বইগুলো হাতে নিয়ে নীলার অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। মোহগ্রস্তের মতো নীলা একটির পর একটি বই হাতে নেয়, ঘোর আবেশে শোঁকে বইগুলো, বুকে চেপে ধরে। পেছনে ক্রমাগত ডেকে যায় কিষান, নীলার কানে পৌঁছে না কারও ডাক।
জিবার থেকে নীলাকে প্রায় টেনে বার করতে হয়। তখনও বিহ্বল চোখ নীলার, তখনও মোহাবিষ্ট, তখনও বিবশ অস্তিত্ব তার, ফরাসি ভাষাটা শেখা দরকার আমার।
কিষান দ্রুত গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, সে তো শিখতেই হবে। যে দেশে থাকবে, সে দেশের ভাষা না জানলে চলবে কেন!
শিখতে চাই ফরাসি সাহিত্য পড়তে। নীলা বলে।
ও তুমি তো আবার বইপোকা বলে শুনেছি। কিষান খ্যাক করে হাসে। ঠোঁট বেঁকে থাকে সে হাসিতে।
কলকাতায় বইপোকা বলে নীলার দুর্নাম আছে। বই পেলে সে নাওয়া খাওয়া তো ভোলেই, নিজের নামও নাকি ভুলে যায়, বাড়ির লোকেরা তো বলেই, বাড়ির বাইরেও বলে।
কী ব্যাপার জোরে হাঁটো। কিষান তাড়া দেয়।
চলো না এই ফোয়ারাটার সামনে বসি।
না আজ নয়।
ওটা তো সেইন নদী। চলো নদীর ধারে হাঁটি।
আরেকদিন। কিষান কাটিয়ে যায়।
গাড়িতে উঠে কাগজে মোড়া একটি প্যাকেট নীলার হাতে দিয়ে কিষান বলল, বাড়িতে নিয়ে খুলবে।
প্যাকেটটি কোলের ওপর রেখে, নীলা আবার অস্থির হয়, আচ্ছা, এখানে বেশ তো সিনেমা, চলো সিনেমায় যাই।
ধুর, ও তুমি বুঝবে না, সবই ফরাসি…কিষানের ঠোঁট উলটে থাকে।
কেন ইংরেজি ছবি নেই বুঝি…
ফরাসিরা ইংরেজি জানে না, জানতে চায় না।
আচ্ছা নাটক ফাটক হয় না, যাও না তুমি নাটক দেখতে?
সময় কোথায়!
প্যারিসে তো কত জাদুঘর। চলো ল্যুভরে যাই।
আজ সময় নেই আর, বাজার করে বাড়ি ফিরতে হবে।
চলো তা হলে অন্তত কোনও ক্যাফেতে বসে চা খাই।
চা তো খেয়েই এলে তাজমহল থেকে।