বেনোয়া ঘুরে দাঁড়ায়। আমাকে ছুটি দিয়ে নিজে সুখে থাকতে চাইছ, বলে সুটকেস নামিয়ে রেখে, ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলতে থাকে দু হাতে। বুটের তলায় চেপে ভেঙে ফেলে সিডিগুলো। গানের যন্ত্রটি আছাড় দিয়ে ভাঙে। ভাঙে ঘরের ফুলদানিগুলো। টেলিভিশন লাথি লাগিয়ে ভাঙে। হাতুড়ি নিয়ে কম্পিউটার ভেঙে গুঁড়ো করে। লাইব্রেরির বইগুলো ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে ছুরি নিয়ে এসে সোফার মাঝখানে চিরে দেয়। বিছানা টেনে নামিয়ে লেপ তোশক বালিশ কেটে ছিন্ন করে। আলমারি খুলে নীলার কাপড়চোপড় ছুরিতে কাটে। বিশাল তাণ্ডব বয়ে যায় ঘরের ওপর। নীলা নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখে।
এরপর নীলার গলা চেপে ধরে দুহাতে বেনোয়া। বদমাশ বেটি, আমি তোকে খুন করব।
নীলার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। দুহাতে সমস্ত শক্তি দিয়ে সে বেনোয়ার হাত ছাড়ায়।
বেনোয়া ধাক্কা দিয়ে নীলাকে মেঝেয় ফেলে। মেঝেতে থুবড়ে পড়লে, পিঠে সেই শক্ত বুটের লাথি, ঠিক মিমিজঁর সমুদ্রপাড়ের লাথির মতো। মাংস কাটার বড় ছুরিটি হাতে নিয়ে নীলার বুক বরাবর উঁচু করে।
সারা গা হিম হয়ে থাকে নীলার। চোখ বুজে থেকে সে নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনে।
ছুরিটি নীলার পিঠের পেছনে থুবড়ে পড়েছে। তোর মতো কীটকে মেরে, আমার হাত নোংরা করতে চাই না। তুই এমনিতেই পচে মরবি।
বেনোয়া বেরিয়ে যায়। নীলার ফরাসি প্রেমিক বেরিয়ে যায়। নীলার সুদর্শন সুপুরুষ বেরিয়ে যায়, নীল চোখ বেরিয়ে যায়, সোনালি চুল বেরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ ওভাবেই পড়ে থাকে নীলা মেঝেয়। অনেকক্ষণ নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনে না সে। উঠতে গেলেই সারা গায়ে যন্ত্রণা হয়।
উঠে যখন দাঁড়ায়, চারটে কাজ করে সে।
.
এক, ফুসফুস ভরে শুদ্ধ বাতাস নেয়। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখে সবুজে লালে হলুদে ছেয়ে আছে প্রকৃতি। আকাশের নীলের তলে, মেঘের সাদার তলে, পত্রপুষ্পাবলীর বর্ণিল উৎসব। নীলা আগে কখনও শরতের এমন আশ্চর্য রূপ দেখেনি, প্রকৃতিকে এমন অপরূপ সাজে সাজতে দেখেনি।
এই দেশ কি তার দেশ? নীলা জানে, শরতের বিচিত্র সাজে সাজা অনিন্দ্যসুন্দর এই দেশটি তার নয়।
.
দুই, দানিয়েলকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে যে তার গর্ভপাত করাতে হবে, ও কোনও সাহায্য করতে পারবে কিনা। দানিয়েল সোৎসাহে বলে, নিশ্চয়ই। তা ঘটনা কী?
ঘটনা ছোট্ট, প্রেমের ফাঁদে পড়েছিলাম, ফাঁদ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছি।
জানতাম। দানিয়েল দেখলে তো ধরনের হাসি হেসে বলে, আগেই সতর্ক করেছিলাম। আগেই বলেছিলাম, খামোখা এই লোকের পেছনে সময় নষ্ট করো না।
নীলা বলে, সময় কখনও নষ্ট হয় না দানিয়েল। এ সময়টা অভিজ্ঞতা অর্জনে গেছে। এর প্রয়োজন ছিল। না হলে সারাজীবন একটা ভুল বিশ্বাস নিয়ে থাকতাম। আমার মনে হচ্ছে, পুরুষেরা যে দেশেরই হোক না কেন, যে সমাজেরই, সব এক।
দানিয়েলের কৌতূহল টগবগ ফুটছে, তা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী তোমার? দেশে ফিরে যাচ্ছ?
কোন দেশে? নীলা জিজ্ঞেস করে।
কোন দেশে আবার? তোমার নিজের দেশে?
আমার কি নিজের বলে কোনও দেশ আছে? দেশ মানে যদি আশ্রয় হয়, নিরাপত্তা হয়, সুখ স্বস্তির নাম হয়, ভারত আমার দেশ নয়।
দানিয়েল বলে, তা হলে এখানেই থেকে যাও। তুমি তো একবার বলেছিলে, প্রতিটি মানুষের দুটি মাতৃভূমি, একটি তার নিজের, অন্যটি ফ্রান্স।
মেয়েদের কি আসলেই কোনও দেশ বা মাতৃভূমি থাকে দানিয়েল? আমার কিন্তু মনে হয় না।
.
এই প্যারিস শহরে পঞ্চাশের দশকে সিমোন দ্য বোভোয়া গর্ভপাতের পক্ষে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এই শহরের ছয় এরনদিসমোয় একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে মেয়েদের অবৈধভাবে গর্ভপাত করাতেন। গর্ভপাত বৈধ করা হয়েছে ওই আন্দোলনের ফলে। নীলার আনন্দ হয় ভেবে যে এই শহরে ওই আন্দোলনের ফসল সে ভোগ করতে যাচ্ছে।
.
তিন, মোজাম্মেলকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে মডিবো কেমন আছে? মডিবোর কোনও ফোন নম্বর আছে কি না। ওর বাড়ির ঠিকানাই বা কী?
মোজাম্মেল যতটুকু জানে মডিবোর খবর তা জানায়। শেষে বলে, ও হন্যে হয়ে একটা ফরাসি মেয়ে খুঁজছিল যেন প্রেমে পড়িয়ে বিয়ে করতে পারে, এ দেশে থাকার অনুমতি পাওয়ার জন্য। সুখবর, মজিবো সাদা এক ফরাসি মেয়ে পেয়ে গেছে।
প্রায় চার হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে গৌরবর্ণ আর্য এসে কালো দ্রাবিড়দের তাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতের আরও দক্ষিণে। গৌরের জয় গেয়েছিল আর্যরা, গৌর উত্তম, কালো অধম, গৌর প্রভু, কালো দাস, গৌর বড়, কালো ছোট, বড় জাত, ছোট জাত, ওই ছিল ধর্ম ওদের, ওই ছিল সমাজ। রক্তের কণায় কণায় ঢুকে গেছে ওই বিশ্বাস। দুশো বছরের ইংরেজ শাসনকাল ওই বিশ্বাসকে আরও পোক্ত করেছে, সাদা ভাল, সাদা জ্ঞানী, সাদা প্রভু। নীলার রক্তকণিকাতেও ছিল ওই বিশ্বাস, মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছিল, ঝেড়ে বিদেয় করলেও কোথায় যেন সামান্য থেকে যায়, ওই সামান্যটুকুর শেষ কণা নিশ্চিহ্ন করা সহজ নয়, সে জানে, তবে সে কঠিন কাজটিই করে তৃপ্তি পেয়েছে।
.
চার, মরুনিকে বলে বাড়ি গোছানোর কাজে সাহায্য করার জন্য কাউকে পাঠাতে।
ঘন্টায় পঞ্চাশ ফ্রাঁ করে নেয় এক ফিলিপিনো মেয়ে, মারিলু, নীলার বাড়িতে চলে আসে বিকেলেই। ঘরের ভাঙা জিনিসগুলো বড় বড় কালো ব্যাগে ঢুকিয়ে নীচে ফেলে দিয়ে আসে ও। ঘণ্টা তিন লাগে ওর এ কাজ করতে।