কারণটা কী?
দিদি কী বলব…এ সব বলতেও খারাপ লাগে..নতুন পাসপোর্ট করলাম হিন্দু নাম নিয়ে, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে..আমার দেশে ফেরা নিরাপদ নয়, এই বলে…
ডাহা মিথ্যে কথা। মোজাম্মেল নিজেই স্বীকার করছে। মিথ্যে শুনলে নীলার বড় রাগ হয়, কিন্তু মোজাম্মেলের মিথ্যে শুনতে শুনতে নীলা লক্ষ করে, তার রাগ হচ্ছে না।
কী বলব দিদি, মোজাম্মেল মাথা চুলকে বলে, এ সব লুকোনোর জিনিসও নয়। সবাই জানে গরিব দেশের ছেলেরা কীভাবে আসে এ সব দেশে, কী করে থাকে…
মিথ্যে না বললে হয় না?
হয় না। মোজাম্মেল বলে সে যদি বলে যে লেখাপড়া শেষ করে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে ঢাকায়, এ দেশে সে তার বিদ্যে খাটাতে চায়, তার শ্রম খাটাতে চায়, একটি স্বাস্থ্যকর সুন্দর জীবন যাপন করতে চায়, যে জীবনের স্বপ্ন সবাই দেখে, তবে এ দেশ থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে দিতে পারে, অর্থনৈতিক আশ্রয় দেবে না।
ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের কী কোরে করে, নীলার সামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছে বিমানবন্দরে। এ নিয়ে প্রশ্ন করার রুচি হয় না তার।
মোজাম্মেলের পাশে বসে জুয়েল বলে যায় যে সে মেট্রো ইশটিশনে ফল বিক্রি করত, পুলিশের জ্বালায় ও কাজও তার ছেড়ে দিতে হয়েছে।
পুলিশ জ্বালায় কেন?
মেট্রোতে ফল বিক্রি নিষিদ্ধ, তাই। থানায় ধরে নিয়ে যায় প্রায়ই, কাগজ দেখতে চায় কাগজ…
কাগজ কি কারও নেই?
আছে কারও কারও, কেউ কেউ আবার মোটা টাকার চুক্তিতে ফরাসি মেয়েদের বিয়ে করে, বিয়ে করলে থাকার অনুমতি জোটে, নাগরিকও হওয়া যায়। আর বহু বছর মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে একসময় হয়তো বৈধ করে নেয়, একধরনের ক্ষমাঘেন্না করে থাকতে দেওয়া আর কী!
মোজাম্মেল আর জুয়েল বেলভিলের এক বাড়িতে থাকে, সঙ্গে আরও পাঁচজন বাঙালি ছেলে, গাদাগাদি করে ওই এক ঘরেই।
সাতজন? নীলা ঠাণ্ডা চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
কী করব দিদি, খরচ বাঁচাই।
কিষান রেস্তোরাঁর হিসেবপত্তর গুছিয়ে রব দেয়, চলো চলো।
নীলা বলে, কিন্তু আমি যে আরেক কাপ চা খাব!
চা তো খেলেই।
এক কাপে কী হয়! তোমাকে তো বলেছিই আমি খুব চা খোর। নীলা মাথা তুলে স্পষ্ট স্বরে বলে, অনুনাসিক অনুনয় নয়।
কিষানের চলো চলো রবে নীলাকে ঘিরে যারা বসেছিল, এক এক করে সরে যায়, মোজাম্মেল ছাড়া।
দেশে ফিরে যান না কেন? নীলা গলা চেপে প্রশ্ন করে।
দেশে? এত বছর এখানে কাটিয়ে দিলাম এখানে ভাল রোজগারের আশায়, এখন দেশে ফিরে করবটা কী, খাবটা কী, চাকরিও এই বয়সে কী করব, বয়সও চলে গেছে চাকরির। আর মুখ দেখাবই বা কী করে। খালি হাতে ফিরতে হবে সংসারে। এখান থেকে ছোট কাজ করেও অন্তত কিছু টাকা দেশে পাঠাতে পারি। ছোট ভাইটার লেখাপড়ার খরচ পাঠাচ্ছি।
জুয়েল আরেক কাপ কালো চা দিয়ে যায় নীলাকে, ওতে দ্রুত চুমুক দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, এতকাল লেখাপড়া শিখে তা হলে আপনার লাভ হল কী?
লাভ কিছু নেই দিদি। মোজাম্মেল চেয়ার ছেড়ে ওঠে।
ওরাও এখানে আর যারা আছে, সবাই কি আপনার মতোই, মানে এভাবেই এসেছে এদেশে?
সবাই।
সবাই শিক্ষিত? নীলা উদগ্রীব জানতে।
সবাই শিক্ষিত, সবাই। বাচ্চু তো ডাক্তার।
এখানে ডাক্তারি করে না?
নাহ, চাকরি কে দেবে? দেশ থেকে ডাক্তারি পাশ করলেও এ দেশে আবার পরীক্ষায় বসতে হয়। অবৈধভাবে এ দেশে এলে সে পরীক্ষায়ও বসা যায় না। ভাষাটা বড় সমস্যা। বলতে পারলেও লিখতে পারা যায় না।
আপনার আত্মীয়রা জানে যে রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন? নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে।
জানাই না। লজ্জা লাগে…
মোজাম্মেল হেসে ওঠে, হাসতে হাসতে বলে, আমার আত্মীয়রা কী জানে জানেন তো? আমি ডিসি-র পদে আছি…লোকে জানে ডেপুটি কমিশনার, আমি জানি ডিস ক্লিনার।
নীলাও হেসে ওঠে। কিষান অনাহুতের মতো সে হাসিতে ঢোকে, এত হাসির হচ্ছে কী এখানে! চলো চলো।
মোজাম্মেল সরে যায়।
বাহ রান্নাঘরটা দেখে যাব না।
নীলা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে বরিশালি সোহেল পেঁয়াজ কাটছে। বাচ্চু কড়াইয়ে তেল ঢালছে। জুয়েল থাল মাজছে।
কী ডাক্তারবাবু, কী রান্না করছেন?
ঝোল। বাচ্চু হেসে বলে।
কীসের ঝোল?
সবকিছুর।
সবকিছুর মানে? মাছ না মাংসের? কোনটার?
মুরগি গোরু ভেড়া মাছ ডাল সবজি সবকিছুরই এক ঝোল।
নীলা বলে, হায় এ কী কাণ্ড। সব রান্নার এক ঝোল হবে কেন?
হবে দিদি। এটাই নিয়ম।
এ তো সত্যিকার ভারতীয় খাবার হল না তবে।
ঠিক ভারতীয় খাবার নয়। ফরাসি স্বাদে ভারতীয় খাবার।
বাচ্চু জানাল সে জার্মানিতেও এ কাজ করেছে, ওখানে রাঁধত জার্মান স্বাদে ভারতীয় খাবার।
নীলা বলে, আমার বেশ অবাক লাগছে দেখে যে ছেলেরা পেঁয়াজ কাটছে রান্না করছে, থাল ধুচ্ছে দেখতে। এ দৃশ্য আমার জীবনে এই প্রথম দেখছি।
বাচ্চু এক বাটি পেঁয়াজ ঢেলে দিয়ে কড়াইয়ে, বলে, জীবনে কোনওদিন পানিটা গ্লাসে ঢেলে খাই নাই। জগ থেকে কেউ পানি ঢেলে দিত গ্লাসে, তারপর খেতাম। আর রান্নাঘর কাহাকে বলে এবং ইহা কী, এই বিষয়ে ধারণা আমার ছিল না। হয়েছে ইয়োরোপে এসে।
তেলে পেঁয়াজে চি চি শুরু হয়, আর গলা উঁচিয়ে নীলা বলে একরকম ভালই হয়েছে, কী বলেন। এখন বুঝতে পারছেন, মেয়েরা কী কাজটা করে রান্নাঘরে!