বেনোয়ার চোখ, চোখের পাতা কাঁপে, তা হলে কাকে বাসি।
তুমি তোমাকে ভালবাসো। তোমার নিজেকে। আর কাউকে না।
বোকার মতো কথা বোলো না নীলা। বেনোয়া ধমকে ওঠে।
নীলা হাসে। সত্য কথা বললে বুঝি রাগ হয় তোমার? কী জানো বেনোয়া, এতদিনে আমি একটি জিনিস জানতে পেরেছি, আমার বাবা অনির্বাণ, আমার সেই প্রেমিক সুশান্ত, স্বামী কিষানলাল, আর ওই সুনীল এদের চেয়ে তুমি মোটেও আলাদা নও। বাইরেটা দেখলে অবশ্য আলাদা মনে হয়, সুন্দর সুন্দর প্রেমের বাক্য আওড়াও, যখন তখন চুমু খাও, লেডিস ফার্স্ট বলে লেডিসদের আগে যেতে দাও, বা ফুল বাড়িয়ে দাও, বা রান্নাঘরে এটা সেটা করতে সাহায্য করো, বা রাস্তায় প্যারামবুলেটর ঠেলো, তোমাদের মধ্যে খুব ভেতরে, অদ্ভুত এক মিল আছে।
নীলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বেনোয়া বলে, তোমার পেটে আমার বাচ্চা নীলা। তুমি দেখতে পাচ্ছ না আমার কত আনন্দ হচ্ছে এ কারণে!
বেনোয়ার বাহু থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নীলা বলে, একজন মাদাম বাটারফ্লাইয়ের দরকার তোমার বেনোয়া, তাই না? কিন্তু আমার কোনও শখ নেই তা হওয়ার।
কেন একথা বলছ? বেনোয়ার সারা গা থরথর কাঁপে, ভয়ে কি রাগে নীলা ঠিক বুঝতে পারে না।
আমি তোমাকে অনেকদিন অন্যরকম স্বাদ দিয়েছি, একজোটিক সামগ্রীর স্বাদ গন্ধ সবই তোমার পাওয়া হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। নিজের প্রতি আমার এতটুকু বিশ্বাস, এতটুকু শ্রদ্ধাবোধ ছিল না বলে তোমার ভালবাসার মোহে আমি এতদূর এসেছি। এবার মুক্তি দাও, মাদাম বাটারফ্লাইয়ের মতো বাকি জীবন কেঁদে কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্তত এ সুখ তোমাকে আমি দিতে চাই না। তুমি তো দেখে মজা পেতে চাও প্রাচ্যের বোকা সোকা মেয়ের প্রেম এবং বিরহ। শেষ অব্দি আত্মহত্যা! না। ওটি আমি করছি না।
বেনোয়া ঘন ঘন শ্বাস নেয়, বলে, আমি তোমাকে বিয়ে করব নীলা। তুমি আমার বউ হবে নীলা। পাসকালকে আমি কালই ডিভোর্স দেব। কালই। চলো বিয়ে করি। বিশ্বাস করো আমাকে, আমি তোমাকে বিয়ে করব। তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।
নীলা বেনোয়ার কাঁধে হাত রেখে থরথর কাঁপুনি থামায়।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি যে তুমি আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করব না।
নীলা, তোমার বাচ্চা হবে। আমরা একসঙ্গে থাকব। আমাদের ছেলে নিয়ে আমরা সুখের সংসার করব। সারাজীবনের সুখের সংসার।
না এ বাচ্চা হবে না।
মানে?
হবে না মানে হবে না। আমি অ্যাবরশন করব।
বেনোয়া হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। নীলার পাদুটির ওপর মাথা রেখে কাঁদে। বেনোয়ার চোখের জলে নীলার পা ভিজে যেতে থাকে। অস্ফুট ভেজা কন্ঠে বেনোয়া বলতে থাকে, ন মে কিত পাঁ। ন মে কিত পাঁ। আমাকে ছেড়ো না।
এত নিষ্ঠুর হয়ো না তুমি, বলে বলে বেনোয়া কাঁদে আরও। বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদে। মাথা দেয়ালে ঠোকে। একবার দুবার তিনবার। কপাল কেটে রক্ত বের হয়। চিৎকার করে বলতে থাকে, এ কথা তুমি ফিরিয়ে নাও। সেই ফাটা কপাল মেঝেতে ঠোকে, বলতে বলতে তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না নীলা। নিষ্ঠুর হওয়া তোমাকে মানায় না।
নিষ্ঠুর হওয়া বুঝি কেবল তোমাকে মানায়?
বেনোয়াকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় বসিয়ে নীলা বলে, এমন পাগলামো করার কোনও মানে হয় না।
বেনোয়া নীলাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমার, তুমি আমার। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না। আমি তোমাকে সব দিয়েছি, যত ভালবাসা আছে সব দিয়েছি। ভালবাসা কাকে বলে আবেগ কাকে বলে আমি তোমাকে ভালবেসে বুঝেছি, এত গভীর করে জীবনে কাউকে আমি ভালবাসিনি, আমাকে তুমি কষ্ট দিয়ো না। তুমি আমাকে ভুল বুঝছ নীলা। তুমি বুঝতে পারছ না, তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যাও আমার এ জীবনের কোনও মানে হয় না, আমি আত্মহত্যা করব। পৃথিবীতে অনেক মেয়ে দেখেছি, তোমার মতো কাউকে দেখিনি, তোমার মতো এত ভাল, এত সৎ, এত উদার, এত মায়াময়ী, এত সহিষ্ণু, এত নিঃস্বার্থ কাউকে দেখিনি, কেউ হয় না তোমার মতো। তুমি এই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানবী। তোমার মতো হওয়ার কারও সাধ্য নেই। তোমার কোনও তুলনা হয় না। তুমি যে কত বড়, কত মহান এ তুমি নিজেও জানেন না, আমি জানি। আমার এই তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, অন্ধকার জীবন তুমি আলোকিত করেছ, তোমাকে আমি হারাতে পারব না। যত ভালবাসা আছে আমার, আমি সব দেব, আর কাউকে না। আমাকে তুমি তোমার পায়ের তলায় রাখো। তবু ছেড়ো না।
.
নীলা হো হো করে হেসে ওঠে।
বেনোয়া তুমি পাগল হয়ে গেছ। আবোল তাবোল বকছ।
বেনোয়া ঝটিতে উঠে হাতের সোনার আংটিটি আঙুল থেকে খুলে নীলাকে দেখিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় বাইরে। তুমি আমার বউ হবে, নীলা, বলো, বউ হবে আমার।
নীলা মাথা নাড়ে। সে হবে না।
কেন আমাকে ভুল বুঝেছ? কী করেছি আমি? কোথায় আমার ভুল হয়েছে বলো? বলো শুধরে নিই। যদি হয়ে থাকে আমাকে ক্ষমা করো।
নীলা বলে বেনোয়ার কোনও ভুল হয়নি, ক্ষমা করার কিছু নেই। শোধরানোর কিছু নেই।
তা হলে কেন?
তা হলে কেন, বেনোয়া বলে যায়, হাতের আঙুল গুনে গুনে, সেই প্রথম দিন থেকে আমি তোমার জন্য করেছি। প্রথম দিন গার দ্য নর্দে পৌঁছে দিয়েছি আমার গাড়ি করে। তোমাকে আমি প্যারিসের বিভিন্ন জায়গা চিনিয়েছি। নিজের জন্য সময় দিইনি, তোমার জন্য সমস্ত সময় খরচা করেছি আমি। বাড়ি ভাড়া নেবে বলে তোমার আমি বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি দেখতে নিয়ে গেছি। যখনই ডেকেছ, আপিসের কাজ ফেলে তোমার কাছে চলে এসেছি। এত বিশ্বাস করেছি তোমাকে, প্রথম থেকে তোমার সঙ্গে আমি কনডম ব্যবহার করিনি। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছি। আমি নিজে হাতে রান্না করেছি, টেবিলে খাবার দিয়েছি। বাড়ি পরিষ্কার করেছি। ভ্যাকুয়াম করেছি। জল চাইলে জল এনে দিয়েছি। চা করে দিয়েছি। তোমার ওই বদমাশ বাঙালি বন্ধু তোমাকে ধর্ষণ করে গেলে আমি তোমাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। আমি তোমার ভয় দূর করেছি।