.
ফ্লোরেন্সে বাকি দুদিন থমথমে সময় কাটিয়ে ভেনিসে গেল দুজন। ভেনিসে কোনও গাড়ি ভাড়া করল না নীলা। দরকারও নেই। জলে থইথই করছে সব, গাড়িঘোড়া যা চলে, জলের ওপর চলে। নীলা স্বস্তি পায় এই ভেবে যে অন্তত বেনোয়া একরকম মুক্তি পেল চালক হওয়ার অপমান থেকে। এবার কী করবে, চলো গণ্ডোলায় ঘুরে বেড়াই। গণ্ডোলায় করে ভেনিসের প্রাসাদ দেখা, আস্তর খসে পড়া কদাকার বাড়ি দেখা, কারাগার দেখা সবই হল। ভেনেসিয়ানরা আর ভেনিসে থাকে না, চলে গেছে পাদোবায়, বা আশেপাশের গ্রামে, ভেনিসে এত চড়া দামে জীবনযাপন সম্ভব নয় ওদের। আমেরিকান আর জাপানের ধনীরা এসে ভেনেসিয়ানদের বাড়িঘর কিনে নিয়েছে, সারাবছর জানালা বন্ধ থাকে বাড়িগুলোর, বছরে একবার জানালা খোলে, ধনীদের যখন গণ্ডোলায় ভেসে বেড়াবার শখ হয়।
দীর্ঘশ্বাসের সেতুতে হাঁটতে গিয়ে নীলা দাঁড়ায়। জানো ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতা লিখেছেন এই দীর্ঘশ্বাসের সেতু নিয়ে। প্রাসাদ থেকে বন্দিরা কারাগারে ঢুকতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত এই সেতুতে দাঁড়িয়ে, শেষবারের মতো দেখে নিত নীল লেগুন। আহা।
নীলা আহা বলল একশো কবুতরের সঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রাসাদের পেছনের চত্তরে, উড়িয়ে দিয়ে ঝাঁক ঝাঁক কবুতর।
কী ব্যাপার, কবুতরদের ওড়াচ্ছ কেন এভাবে? ওরা খাচ্ছে খাক।
উড়িয়ে দিচ্ছি, কারণ আমার হিংসে হয় ওদের। তাই।
কবুতরকেও হিংসে করো?
হ্যাঁ করি।
কেন?
ওদের মতো উড়তে পারি না বলে।
বেনোয়া একা হেঁটে গেল একটি ক্যাফের দিকে। নীলা দাঁড়িয়ে রইল ঝাঁক ঝাঁক নেমে আসা কবুতরের সঙ্গে। একা।
.
রাতে হোটেলের ঘরে শুয়ে নীলা জিজ্ঞেস করে, অভিমান বলে চমৎকার একটি বাংলা শব্দ আছে। অন্য কোনও ভাষায় এই শব্দটির ঠিক অনুবাদ হয় না। ফরাসি ভাষায় কি এই শব্দটির অনুরূপ কোনও শব্দ আছে?
উত্তর দেবার সময় হয় না বেনোয়ার, কারণ ওর মোবাইল বেজে ওঠে। পাসকালের ফোন।
ফোনে কথা শেষ করে এসে প্রায় ঘুমিয়ে পড়া নীলাকে জাগিয়ে অন্যরকম তরলের স্বাদ নেয় বেনোয়া। অন্যরকম শরীরের, অন্যরকম রঙের, অন্যরকম ভঙ্গিমার, অন্যরকম দোলের।
বেনোয়া তার না-নিখুঁত শরীর দিয়ে নীলার শরীর ঢেকে দিতে দিতে, নীলার অন্যরকম রহস্যের ভেতরে, ঢুকি কি ঢুকি না, ঢুকি কি ঢুকি না ধরনের খেলা খেলতে খেলতে বিষম বেগে নিজেকে ঠেলে দেয় ভেতরে।
আমাকে টের পাও? আমাকে অনুভব করো?
নীলার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বেনোয়া বলে যায়, বলো, বলো আমাকে ভালবাসো। বলো খুব ভালবাসো আমাকে। বলো আমাকে পাগলের মতো ভালবাসো। বলো জ তেম আলা ফলি। বলো আলা ফলি। বলো, আমি তোমার সব। বলো যে আমাকে ছাড়া বাঁচবে না তুমি। বলো যে আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসবে না। বলো নীলা বলো।
নীলা মুখ সরিয়ে নেয়, বেনোয়ার মুখ থেকে মরা ইঁদুরের গন্ধ বেরোচ্ছে। এ গন্ধ বেনোয়ার মুখ থেকে প্রায়ই বেরোয়, নীলার কেবল একে গন্ধ বলে কোনওদিন মনে হয়নি। অথবা, কী জানি, নীলা ভাবে, হয়তো সুগন্ধ বলেই মনে হয়েছে।
.
এখানেই শেষ
এ মাসে ঋতুর দেখা পায়নি বলে নীলা ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানায়, নীলার পেটে বাচ্চা। ডি এন এ পরীক্ষা করে বেনোয়া দুপঁ হচ্ছে বাচ্চার বাবা, তাও বলে কশঁ হাসপাতালের ডাক্তার।
বেনোয়া বিপুল উল্লাসে মেতে ওঠে। হাসপাতালের করিডোরে একশো লোকের মধ্যে নীলাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে চুমু খায়। সারা পথ চুমু খেতে খেতে, আমার জীবন সার্থক হল, আমার স্বপ্ন পূর্ণ হল বলতে বলতে বাড়ি ফিরে নীলাকে কোলে তুলে দোল খায়, নীলাকে বুকের মধ্যে নিয়ে প্রচণ্ড আবেগে বলে, বারবার বলে জ তেম জ তেম জ তেম। জ তেম আলা ফলি।
এই পৃথিবীতে আমার মতো সুখী আর কেউ নেই নীলা, আমার মতো ভাগ্যবান আর কেউ নেই।
নীলার উদাস দুটো চোখ জানালায়।
উদাস মুখটি বেনোয়া নিজের দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী ভাবছ এত! আমাদের ছেলের নাম কী দেবে তাই নিয়ে? বাংলা নাম দিতে চাচ্ছ তো।
নীলা বলে, ভাবছি আমার একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে। টাকা পয়সা যা ছিল, সব ফুরিয়েছে।
ও ভেবো না, সে আমি দেখব। নীলার পেটের মসৃণ বাদামি ত্বকে চুমু খেতে খেতে বলে বেনোয়া।
এ বাড়িটা আর পোষাতে পারব না, ছেড়ে দিতে হবে পরের মাসে।
কী জানো, বেনোয়া উঠে বসে, মুখে তৃপ্তির হাসি, তোমাকে আমি আমার বাড়িতে ওঠাব। পাসকাল অন্য এলাকায় বাড়ি ভাড়া নেবে। বেশ হবে, তাই না?
বেনোয়ার চোখের ওপর নেমে আসা কটি সোনালি চুল সরিয়ে দিয়ে নীলা বলে, ও বাড়িতে তুমি পাসকালের সঙ্গে থেকো।
বেনোয়া লাফিয়ে বিছানা থেকে নামে। কী বলছ তুমি? তুমি কি ভাবো পাসকালকে আমি তোমার চেয়ে বেশি ভালবাসি?
নীলা বলে, না, এটা আমি ভাবছি না।
তা হলে তুমি জানো যে তোমাকে আমি কী ভীষণ রকম ভালবাসি।
না বেনোয়া তুমি আমাকে ভালবাসো না। অদ্ভুত শান্ত স্বর নীলার।
নীলাকে এক ঝটকায় শোয়া থেকে ওঠায় বেনোয়া, কী বলছ কী তুমি?
বেনোয়ার হাত সরিয়ে নিজের বাহু থেকে, নীলা বলে, আমি ঠিকই বলছি।
তা হলে ওই হিংসেটা এখনও যায়নি তোমার, পাসকালের সঙ্গে আমার দুটো কথা বলাও তুমি সহ্য করতে পারো না! ভাবো যে পাসকালকে আমি ভালবাসি।
নীলা বেনোয়ার চোখে কালো গভীর শান্ত চোখ রেখে বলে, বেনোয়া তুমি পাসকালকে ভালবাসো না।