বেনোয়ার হাতে রেনো, মডেল অথেনটিক ১৪, ১৩৯ জি/কিলোমিটার, পাঁচ দরজা লেখা ডিলারের কাগজখানা দিয়ে নীলা বলে, কাল যে কোনও সময় গিয়ে গাড়িটি নিয়ে এসো।
.
নীলা শুতে যায়। ক্লান্ত সে।
.
অভিমান
কী জানো তুমি গাড়ির? একা একা গাড়ি কিনতে গেলে কেন? আমাকে বললেই পারতে? পুরো সকাল বেনোয়া চেঁচাল।
কেন গাড়িটি কি কাপুত হয়ে আছে? চলে না?
এ টাকায় আরও ভাল পাওয়া যেত। তুমি ঠকেছ।
নীলা হেসে বলে, আমি সারাজীবন ঠকেছি বেনোয়া। ঠকে আমার অভ্যেস আছে।
বেনোয়ার গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, তুমি খুশি হওনি?
নীলার বাহুদুটো ছাড়িয়ে বেনোয়া দূরে গিয়ে বসে বলে, শোনো এরকম আর করবে, আমাকে না জানিয়ে অচেনা লোককে বাড়িতে ডাকবে না। আজকাল প্যারিসে অনেক চুরি ডাকাতি হচ্ছে।
.
দেড় সপ্তাহের ছুটি পেয়েছে বেনোয়া। এই ছুটিতে সে কী করবে, জানে না। ফোনে স্ত্রী কন্যার খবর নেয় সকাল বিকাল। ওরা দ্বীপে পৌঁছেছে, সমুদ্রে সাঁতার কাটছে, ভাল হোটেলে আছে।
প্যারিস খাঁ খাঁ করে, বেনোয়ার মনও খাঁ খাঁ করে। সে কখনও আগস্টের ছুটিতে প্যারিসে কাটায়নি।
নীলা বলে চলো মিউচুয়ালিতে তে যাই, ওখানে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে।
ছোঃ নারীবাদীদের অনুষ্ঠান। ওখানে খামোখা চিকন গলায় দাবি করবে এই চাই সেই চাই, এরা তুষ্ট হয় না কখনও। যতসব সমকামী আর কুৎসিত দেখতে মেয়েদের জমায়েত ওখানটায়।
বিজ্ঞাপনে মেয়েদের শরীর ব্যবহার করা যাবে না, কোনও যৌন ইঙ্গিত চলবে না, যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সুড়সুড়ি জাগানো বিজ্ঞাপন দেবে তাদের দ্রব্যসামগ্রী বর্জনের পক্ষে জোর হাততালি পড়বে আজ মিউচুয়ালিতেতে, আজকের অনুষ্ঠানটিই এ নিয়ে। যৌন ব্যাপারটি নীলার কাছে মোটে অনাকর্ষণীয় মনে হয় না। ভারতে যৌনতা হচ্ছে নিষিদ্ধ জিনিস, ইয়োরোপে নয়, শরীর এবং মনের এই স্বাধীনতা ইয়োরোপে আছে বলেই নীলার মনে হয় যৌন কেলেঙ্কারি এখানে কম ঘটে, যে স্বচ্ছন্দে এ দেশে মেয়েরা স্বল্প পোশাকে হেঁটে বেড়ায়, তা ভারতে সম্ভব নয়। নীলার ইচ্ছে করে যেমন ইচ্ছে তেমন পোশাক পরতে। উলঙ্গ হতে ইচ্ছে করলে উলঙ্গ হবার অধিকার তার থাকবে না কেন। মেয়েরা গা ঢেকে রাখলেও, বিজ্ঞাপন যৌনহীন হলেও পুরুষের মনে যৌনকামনা জাগবে। বড় ব্যাপার হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, সেটি থাকলে কোনও কিছুতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে না। নীলা ভাবে, যদি মিঠুর নিশ্চল শরীরটি নিয়ে আজ মিউচুয়ালিতেতে রাখা যেত! যদি মলিনার পুরো জীবনের গল্প শোনানো যেত শ্রোতাদের। মলিনাকে বা মিঠুকে কেউ যৌনসামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করেনি। কেউ ওদের দিকে লোভের হাত বাড়ায়নি! অথচ এক অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে হয়েছে মলিনাকে, মিঠুকেও। যৌনতাকে একরকম সম্পদ বলে মনে হয় নীলার, যৌনবোধ আছে বলেই, নীলা যৌনসুখ দিতে পারে বলেই বেনোয়া তাকে ভালবাসছে। তা না হলে, দুর্বিষহ একাকিত্ব নিয়ে মলিনার মতো জীবন পার করতে হত, অথবা করতে হত মিঠুর মতো আত্মহত্যা। কীটের মূল্যও সম্ভবত জুটত না নীলার, বেড়াল কুকুরের মূল্যও নয়। ওয়ান্ডাকে যেভাবে আদর করে বেনোয়া, নীলাকে করত না, যদি না নীলার স্তন এবং জঙ্ঘায়, নীলার যোনিরসে, যোনিদেশে অপার আনন্দের খোঁজ না পেত। ভালবাসার বড় কাঙাল সে, ভালবাসা পাওয়ার জন্য যৌনতার যদি প্রয়োজন হয় হোক।
হঠাৎ সুনীলের মুখটি চোখের সামনে ভাসে নীলার, গা গুলিয়ে ওঠে।
আমার কিন্তু ও অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা। তুমি না গেলে বরং আমি একা যাই।
তুমি একা যেতে চাচ্ছ? আর আমি ঘরে একা বসে থেকে আমার ছুটিগুলো নষ্ট করব?
নীলার মিউচুয়ালিতেতে যাওয়া হয় না।
থমথমে দিন পেরোয়, পরদিনও। তার পরদিন বেনোয়া তার রু দ্য রেনের বাড়ি যায় কিছু নাকি কাগজপত্র আছে, গোছাতে। বাড়িতে নীলার একা লাগে খুব, সে বেরিয়ে যায়, বেরিয়ে এদিক ওদিক হেঁটে ঢোকে ক্যাটাকম্বে। মানুষের হাড়ে সাজানো পাতাল। মাটির তলে অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে দুপাশে রাখা কোটি কোটি মানুষের হাড়, খুলি দেখতে দেখতে সে নিশ্বাসের শব্দ শোনে, মৃত্যুর, মৃত্যু যেন তার কাঁধে এসে বসেছে, যেন তার পিঠের ওপর চড়েছে, নীলার হঠাৎ মনে হয় সে বেঁচে নেই। বুঝি সে ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে হাড় হয়ে গেছে, লক্ষ লক্ষ অচেনা হাড়ের সঙ্গে তার হাড়ও মিশে গেছে। দ্রুত সে পাতাল ছাড়ে। বাড়ি ফেরে। স্নান করে গা থেকে হাড়ের গন্ধ দূর করে আলোর দিকে মুখ করে বসে থাকে বারান্দায়, ট্রেসির ভারী গলায় গাওয়া গানটি তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়, ইফ ইউ থিঙ্ক অব মি, ইফ ইউ মিস মি ওয়ান্স ইন এ হোয়াইল, দেন আই উইল রিটার্ন টু ইউ, আই উইল রিটার্ন অ্যান্ড ফিল দেট স্পেস ইন ইওর হার্ট, রিমেমবারিং ইওর টাচ ইওর কিস ইওর ওয়ার্ম এমব্রেস আই উইল ফাইন্ড মাই ওয়ে ব্যাক টু ইউ ইট উড ফিল সো গুড টু বি ইন ইওর আর্মস হোয়ার অল মাই জানিস এন্ড…।
বেনোয়া ফিরে এলে, ওর মন খারাপ করা মুখের দিকে তাকিয়ে নীলা বলে, চলো ইতালি থেকে ঘুরে আসি। এ মুহূর্তে দেশের বাইরে যাওয়ার মতো কোনও টাকা নেই বেনোয়ার, জানায়। স্ত্রী কন্যাকে ক্যানারি দ্বীপে পাঠানোয় অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে।