সানালের অভিনন্দনের জবাব দেয় নীলা মেরসি বিয়াকুপ বলে।
উৎসবে তুমুল হর্ষধ্বনি।
বেনোয়া শোবার ঘরে চলে যাবার পরও নীলা মোজাম্মেল, জুয়েল আর মডিবোকে নিয়ে আরও রাত পার করতে থাকে। মোজাম্মেল সেই রাঁধুনি বাচ্চুর খবর দেয়, ফ্রান্সে কাগজ পায়নি, তাই ইতালি যাচ্ছিল, দালালকে প্রচুর টাকা দিয়ে ইতালি যাবার ব্যবস্থা করেছিল, দালালই বলে দিয়েছিল কী করে যেতে হবে, কখন দৌড়োতে হবে, কখন লাফিয়ে পড়তে হবে, সব। ইতালির সীমানায় পৌঁছোনোর আগে ট্রেন থেকে অন্ধকারে লাফ দিয়েছিল বাচ্চু, যা নিয়ম। তারপর ট্রেন চলে গেলে লাইনের ওপর দৌড়োনো, পেছনে কোনও ট্রেন এলে, আবার ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়া। এই করে যা হোক, কিছুটা এগিয়েছিল, পেছন থেকে বেমক্কা ধাক্কা দিয়েছে একটি ট্রেন, বাচ্চু ওখানেই শেষ।
মীলার বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে।
জুয়েলের এ দেশে আসার গল্পটি শুনতে শুনতে নীলা গেলাসে আরও ওয়াইন ঢালে।
জুয়েল ঢাকা থেকে মস্কো গিয়েছিল, মস্কো থেকে সবজির ট্রাকে করে পৌঁছেছে রুমানিয়ার এক শহরে, ওখান থেকে সীমানা পার হয়ে চেক রিপাবলিকের দিকে, তারপর ওখান থেকেই বরফের পথে সীমানা পার হয়ে জার্মানি। জুয়েলের ভাই রুবেল ছিল জুয়েলের সঙ্গে। জীবনে এর আগে কখনও কখনই বরফই দেখেনি, না জুয়েল, না রুবেল। দ্রুত দৌড়োত পারবে ভেবে জুতো খুলে দৌড়েছিল রুবেল, বরফের কামড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ওখানেই…
নীলার মনোযোগ ভাঙে বেনোয়ার ডাকে।
শোবার ঘরে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে বেনোয়া, চোখে আর কপালে পনোরোটির জায়গায় ষোলোটি ভাঁজ, বাড়তিটি ছাব্বিশে পড়ার।
কারা এরা? কী এত কথা বলছ এদের সঙ্গে? দেখছ না এখানে একা বসে আছি!
বেনোয়ার বুকের ওপর ওয়ান্ডা বসা। নীলা বলে, একা নও তো, ওয়ান্ডা আছে।
বেনোয়া কটমট চোখে তাকায় নীলার দিকে। নীলা বলে, ও ঘরে চলো।
ও ঘরে যাব কেন? কী ভাষায় কথা বলছ ও সব!
বাংলায়। অনেকদিন বাংলা বলি না। বলতে ভাল লাগছে।
আমি যখন তোমাকে বাংলা শোনাতে বলি, তখন তো বলো না।
তুমি তো বাংলা বোঝো না বেনোয়া। তুমি তো বাঙালি নও।
তা আগে বলতে আমাকে যে বাঙালির আড্ডার আয়োজন করেছ।
বাঙালির আড্ডার আয়োজন করলে মরুনি, ফ্রেডেরিক আর সানালকে ডাকতাম না। মডিবোর তো প্রশ্ন ওঠে না। ও জানেই না, বাংলা বলে জগতে কোনও ভাষা আছে।
তোমার বন্ধুদের তুমি খাওয়াবে, ওদের সঙ্গে আড্ডা দেবে, আসল উদ্দেশ্য তো এটাই ছিল। খামোকা আমার জন্মদিনের উৎসব করছ, তা বলার কী দরকার ছিল?
নীলা কোনও উত্তর না দিয়ে ও ঘরে জুয়েলের বাকি গল্প শুনতে যায়। পুলিশ এসে রুবেলকে তুলে নিয়ে যায়, রুবেলের পা কেটে ফেলতে হয়, দু পা-ই। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়ে পা পচে যাচ্ছিল। চিকিৎসার পর রুবেলকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে জার্মান সরকার। জমি জিরেত বিক্রি করে লক্ষ টাকা খরচ করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করার স্বপ্ন দেখে ঢাকা ছেড়েছিল রুবেল, আর তাকে ঢাকায় পৌঁছোতে হল অর্থনৈতিক, শারীরিক, আর মানসিক পঙ্গুত্ব নিয়ে।
কুড়ি বছর বয়স ছিল রুবেলের। মোজাম্মেল বলে।
জুয়েল জুতো পরে দৌড়েছিল বলে বরফের কামড় থেকে বেঁচেছে, পুলিশের চোখ থেকেও। জার্মানি থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে এসেছে। পুলিশ যে কোনও দিন ঘাড় ধরে পাঠিয়ে দিতে পারে দেশে, অনিশ্চয়তা প্রতি মুহূর্তে। ফেরতই যদি যেতে হয় দেশে, একটিই স্বপ্ন তার, যেন পঙ্গু না হয়ে ফেরত যেতে পারে।
মডিবোও ভবিষ্যৎ গড়তে এদেশে এসেছে, তমবকটু শহরে স্রোতস্বিনী নাইজেরের তীরে শৈশব কৈশোর ফেলে। মডিবো সোনকনোর পুরু ঠোঁট ঝুলে থাকে তার ভবিষ্যতের মতো। পুলিশ থেকে পালিয়ে, বাতিল বাড়ির অন্ধকার কোঠায় ঘুমিয়ে, গির্জার দাঁতব্য খাবার খেয়ে মডিবো বেঁচে থাকছে। গায়ে শক্তি আছে, মনে সাহস, এ দুটোও দিন দিন ঠোঁটের মতো ঝুলে পড়ছে।
এ সময় সবাইকে হতবাক করে বেনোয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, কোথায় যাচ্ছ এত রাতে? কী হল কী? বলতে বলতে নীলা পেছনে পেছনে দৌড়েছিল। নাগাল পায়নি, কনকর্ডের চেয়েও দ্রুত গতি ছিল বেনোয়ার প্রস্থানের।
মডিবোর গল্প মাঝপথে থামাতে হয়। ওদের চলে যেতে হয়। বেনোয়ার গতি এক গুমোট হাওয়া ফেলে গেছে পেছনে, এ হাওয়া সবাইকেই, নীলাকেও উদ্বিগ্ন করে।
বেনোয়া মিনিট পনেরো পর ফোন করে লোকগুলো গেছে কি না জিজ্ঞেস করে, গেছে নিশ্চিত হয়ে, বাড়ি ফেরে।
ওরা সারারাত থেকে যেতে চেয়েছিল নাকি? তোমার আড্ডাবাজির উৎসব তো শেষ হতেই চাইছিল না। দিনটাই মাটি হল। পাসকাল চেয়েছিল আমাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে। তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে যাইনি। জ্যাকলিন জন্মে প্রথম দেখল, আমার জন্মদিনের দিন আমি ওর কাছে নেই। পাসকাল আজ সারাদিন আমাকে মনে করে কেঁদেছে। আর আমাকে তোমার এই রঙ্গ দেখতে হল।
নীলা বলে, তোমাকে তো আমি না করিনি ও বাড়িতে যেতে।
করোনি, কিন্তু চাও না তো! গেলেই তুমি জিজ্ঞেস করবে পাসকালের সঙ্গে শুয়েছি কি না। তোমার তো শোয়া ছাড়া আর কিছু মাথায় নেই।
গেলাসে ওয়াইন নিয়ে বিছানার সামনের সোফায় বেনোয়া ষোলো ভাঁজ নিয়ে বসে পান করে।
তুমি যে কী করো, তার মাথামুণ্ডু আমি কিছু বুঝি না, কী দিয়েছ আমাকে এটা কাগজে মুড়িয়ে? কীসের চাবি এটি। চাবিটি নীলার দিকে ছুঁড়ে দেয় বেনোয়া।