সোলারিয়ামটা কী জিনিস? এ হল কৃত্রিম সূর্যরশ্মি গায়ে ফেলা, রং বাদামি করার জন্য। নিকল মিশেল রিতা এই তিনজনের দুজন প্যারিসে নেই, একজন জানাল, ঠিক এই দিনটিতে কোনও এক বন্ধুর সঙ্গে তার কফি খাবার কথা আছে, আর এ ব্যাপারটি পাকা হয়ে আছে গত চার মাস থেকে, সুতরাং হচ্ছে না। মোজাম্মেলকে নেমন্তন্ন করলে ও লাফিয়ে ওঠে খুশিতে, দিদি এতদিন কোথায় ছিলেন? কত ভেবেছি আপনার কথা! ওই বাক্সবন্দির কারখানায় খুঁজেও এসেছি দুদিন। মোজাম্মেলের উচ্ছ্বাসকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে নীলা বলে, মোজাম্মেল তার বন্ধুদেরও নিয়ে আসতে পারে। সানাল জানাল সে আসছে। সানালের কাছ থেকে জানল বাবু গোগিনি আর তার বউ হায়দ্রাবাদ গেছে। তারিকের নম্বর নিয়ে জানল, তারিক আর অডিল আসতে চেষ্টা করবে। চৈতালি আর সুনীলকে নেমন্তন্ন করার কথা প্রথম যদিও ভেবেছিল, দ্বিতীয়বার ভেবে, নামদুটো কেটে দেয়। মোট তার অতিথির সংখ্যা দাঁড়ায় সাত। বেনোয়া তার বন্ধু বা আত্মীয় কাকে কাকে নেমন্তন্ন করতে চায় জিজ্ঞেস করলে, বলে, এই আগস্ট মাসে কেউ কি প্যারিসে থাকে নাকি! প্যারিস খালি হয়ে গেছে, পাসকালও আগস্ট কাটাতে চলে যাচ্ছে ক্যানারি দ্বীপে। বেনোয়ার ক্যানারি দ্বীপ দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, এবার নীলার কারণেই তার যাওয়া হচ্ছে না।
উৎসবের আয়োজনে বিষম ব্যস্ত নীলা। মোজাম্মেল খবর নিয়ে জানিয়েছে বাজার সদাই করা আর রান্নায় সাহায্য করতে সে আগে ভাগেই চলে আসতে পারে। নীলা সায় দিল।
উৎসবের দিন দুপুরবেলাতেই মোজাম্মেল জুয়েলকে নিয়ে আসে, জুয়েলকে নীলা দেখেছে কিষানের রেস্তোরাঁয়, বাচ্চা বাচ্চা মুখের ছেলে, মেট্রোয় ফল বিক্রি করা পুলিশের জ্বালায় যার হয়ে ওঠেনি। জুয়েল পেঁয়াজ কাটায় লেগে গেল। ঘরে তো আদা নেই, মোজাম্মেল আদা কিনতে দৌড়োল, আদা নিয়ে আর বেনোয়ার জন্য একটি উপহারের প্যাকেট নিয়ে ফিরল। ছোটখাটো ফরসা মুখের বাইশ কি তেইশ বছর হবে বয়স জুয়েলের, মন দিয়ে পেঁয়াজ কাটল, রসুনও, জিজ্ঞেস করল মাংসটা কি সেই রেঁধে ফেলবে নাকি। রেস্তোরাঁয় কাজ করছে, রান্না শিখেছে, জুয়েলই মাংস রাঁধে। নীলা রুই মাছ ভাজে কড়াইয়ে। সপ্ত ব্যঞ্জন নয়, আয়োজন সপ্তদশ ব্যঞ্জনের। রান্নাঘরেই বনভোজনীয় উৎসব শুরু হয় তিন বাঙালির। রবীন্দ্রসংগীতে দোল খেতে খেতে রান্না শেষ হয়, সন্ধেও পেরিয়ে যায়। সন্ধের মুখে তারিক ফোন করে বলে, পুত্রধনের সিজোফ্রেনিয়া রোগ হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়েছে, মন মেজাজ ভাল নেই, আসা হচ্ছে না।
প্রচুর খাবার নষ্ট হবে গো! নীলা ফোন রেখে বলে।
মোজাম্মেল জিজ্ঞেস করে, একটি ছেলের সঙ্গে তার নতুন পরিচয় হয়েছে, নাম মডিবো, ওকে ডাকবে কি না। মাথা চুলকে বলে, ও কিন্তু কালো। মডিবো মালি থেকে খুব বেশিদিন হয়নি এসেছে। বেচারা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকে, টাকা পয়সা নেই, ভাল খেতে পায় না।
নীলা আজ উদারহস্ত। মডিবো কেন, পারলে জডিবো সডিবো, সবাইকে ডাকুন।
.
বেনোয়া বিকেল হতেই নীলার দেওয়া নতুন প্যান্ট শার্ট পরে, টাই লাগিয়ে তৈরি হয়। নীলা নতুন একটি বালুচরি পরে।
অতিথিরা এসে গেলে শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ওঠে ঘরে। ট্রেসি চ্যাপমেনের রেভুলশন নেপথ্যে। উৎসবের মধ্যমণি বেনোয়া। উপহার এদেশে হাতে পড়ামাত্র খোলার নিয়ম, সানাল তার জন্য এনেছে ভারতীয় মৃত্তিকাশিল্প, ইলোরা অজন্তার মিথুনমূর্তি আদলে। আর মোজাম্মেলের প্যাকেট থেকে বের হয় বুট, বেনোয়া প্রত্যেককে বাহ বেশ সুন্দর তো, বেশ ভাল তো, বলে বলে ধন্যবাদ দেয়। যদিও নীলা জানে, অন্তত অডি তয়লেত ব্রুট বেনোয়ার কাপ অব টি নয়। নীলার উপহারটি একবারে ছোট্ট, লাল কাগজে মোড়া। ওটি ঠিক এক্ষুনি খোলার অনুরোধ করে নীলা। হো হো হাসির রোল, সানালের এক চোখ স্বভাবতই ছোট হয়। নীল বেনোয়াকে ভরা আসরে ঠিক ফরাসি নয়, এই চুমুটি বাঙালি বলে শুকনো একটি চুমু খেয়ে বলে, এই চুমুতে লালা আর লালসা খানিকটা কম।
জন্মদিন বিষয়ে সানাল তার মত প্রকাশ করে, এই দিনটি খুব দুঃখের একটি দিন, এই দিনটি মনে করিয়ে দেয় মৃত্যুর দিকে একটি বছর এগিয়ে যাওয়া হল। সানাল নিজের জন্মদিনে শোক উৎসবের আয়োজন করে, নিজেই নিজেকে নিমন্ত্রণ করে, একা ঘরে দরজা জানালা সেঁটে অন্ধকারে বসে থাকে, উৎসবের নিয়ম হচ্ছে, সারাদিন উপোস থাকতে হবে, টেলিফোনের প্লাগ খুলে নিতে হবে, টেলিভিশনের রিমোট কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলতে হবে। মডিবো, নিকষ কালো অবৈধ ইমিগ্রেন্ট বড় বড় কালো চোখ আর ভোঁতা নাক নিয়ে ট্রেসি চ্যাপমেনের মতো নেপথ্যে থেকে যায়। হাতে গেলাস বটে, গেলাসের শ্যাম্পেন শেষ হয়ে গেলেও মুখ বুজে থাকে। নীলা লক্ষ করে মডিবোকে। সানাল চোস্ত হিন্দিতে বলে, এই হনুমানটাকে এখানে কে নেমন্তন্ন করেছে? সানালের মন্তব্যে মোজাম্মেল আর জুয়েল হেসে কুটিকুটি। নীলা মডিবোর গেলাসে শ্যাম্পেন ঢেলে দিয়ে বলে, আমি।
বাঙালি মশলার খাবারে বরদো নাকি ভাল যায়, বেনোয়ার তাই মত। একটি পর একটি বরদো শেষ হতে থাকে। উৎসব উৎসবের মতোই মাতাল ও রঙিন হয়ে ওঠে। রাত বারোটায় দিকে মরুনি, ফ্রেডেরিক আর সানাল চলে যায়। যাবার আগে, সানাল নীলাকে অভিনন্দন জানায় কারণ নীলার ফরাসি জ্যাকুয়েস লিভস ইন বরদুয়েক্স-এর পর্যায় থেকে যথেষ্ট ওপরে উঠেছে।