নীলা ফুলগুলো শুঁকে বলল, এ দেশের ফুলে দেখেছি একেবারে কোনও ঘ্রাণ নেই। কেবল দেখতেই যা। আমাদের দেশে যে গোলাপ ফোটে, তাতে কী সুন্দর ঘ্রাণ থাকে।
এ সব তো কৃত্রিম ভাবে ফলানো, তাই। ঘ্রাণ যা আছে, কৃত্রিমতা সব শুষে নেয়। বলে নীলার চুলে আঙুল বুলিয়ে বেনোয়া বলে, তোমার ভেতরে কোনও কৃত্রিম কিছু নেই। তাই তোমাকে আমি প্রতিদিনই আরও বেশি করে ভালবাসছি।
তারপর খুব ধীরে ধীরে নীলাকে পাশে বসিয়ে পাশে শুইয়ে সে বলে যায় গত রাতে পাসকালের সঙ্গে তার কী কথা হয়েছে। ওর জন্য বেনোয়ার যে ভালবাসা, অনেক ভেবে সে দেখেছে এটি নেহাত বন্ধুত্বের, আর হৃদয়ের দুকুল উপচে ওঠা ভালবাসাটি নীলার জন্য। ও বাড়িতে রাত কাটানোটা তার উচিত হয়নি, এ সে বুঝেছে। নীলাকে কষ্ট দেওয়ার কোনও অধিকার তার নেই। পাসকাল তাকে বলেছে কোনওরকম দোদুল্যমানতার ভেতরে না থেকে যে কোনও একটি সম্পর্ক বেছে নিতে। যদিও এটি খুবই কঠিন একটি সিদ্ধান্ত এমন সাজানো সুন্দর সংসার জন্মের মতো ছেড়ে দেওয়া, তারপরও বেনোয়া নীলাকেই বেছে নিয়েছে। এখন পাসকালের সঙ্গে একটি সমঝোতার ডিভোর্সে যেতে হবে, ডিভোর্স এ দেশে হুট করে হয় না, ধীরে ধীরে এর মীমাংসা হবে, এ নিয়ে দুজনই উকিলের সঙ্গে কথা বলতে যাবে। জিনিসপত্র ভাগাভাগির ব্যাপারটিও মিটিয়ে ফেলবে, কঠিন নয় তেমন। মাঝে মাঝে বেনোয়া এবং পাসকালের যে কথা হবে তা জ্যাকলিনের ব্যাপারেই হবে। অন্য কোনও ব্যাপারে নয়। পাসকাল বলেছে সে একটা চাকরি জোগাড় করে নেবে, যতদিন না নতুন চাকরির ব্যবস্থা হয়, ততদিন বেনোয়ার ওপর নির্ভর করতে না চাইলেও করতে হবে। আর জ্যাকলিনের জন্য পিতার কর্তব্য তার পালন করতেই হবে যেহেতু এদেশে এরকমই নিয়ম। এ আর কদিনই বা, যেভাবে বড় হচ্ছে, খুব শিগরি চৌদ্দ পনেরোয় পড়বে, তারপর তো বাড়ি ছেড়েই দেবে, নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেবে।
বেনোয়া শুধু বলেই ক্ষান্ত হয়নি, ফ্রেমে বাঁধানো পাসকালের ছবিটি টেবিল থেকে সরিয়ে খালি সুটকেসে ফেলে রাখে, যার ছবি তাকে একসময় ফেরত পাঠিয়ে দেবে, বলে।
.
সেদিনই সেই শুক্রবারে নীলার কাছে রেজেস্ট্রি ডাকে কিষানলালের উকিলের পাঠানো চিঠি আসে। নীলার সঙ্গে কিষানলালের বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরুর বার্তা। চিঠিটি হাতে নিয়ে বসে সে নিজের বুকের ধুকপুকির শব্দ শোনে অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ চোখের সামনের আলোগুলো ঝাপসা হয়ে হয়ে নিবে আসে। বেনোয়া সেই অন্ধকারে ফস করে আলো জ্বেলে দেয়, আমার ওপর তোমার বুঝি আস্থা নেই?
নীলার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বেনোয়া আবার বলে, আমার মতো করে তোমাকে এত ভাল কেউ বাসবে না নীলা। কেউ না। বেনোয়ার হাত দুটোয় নিজের হাত দুটো বড় কালো দেখায়।
আমি তোমাকে সর্বস্ব দিয়েছি নীলা। এই আমাকে দিয়েছি। আর কী চাও তুমি বলো! বেনোয়ার নীল চোখ দুটোয় অতলান্তিকের উতল ঢেউ।
বুকের ধুকপুকুনি কেটে যায়। নীলার মুখটি বেনোয়া নিজের দিকে ফেরায়। বিমুগ্ধ নয়নে মহীরুহ দর্শন করে তুচ্ছ তৃণ।
.
কলকাতা থেকে ফেরার পর প্রথম কলকাতার বাড়িতে নীলা ফোন করে, চিঠি পাওয়ার রাতে। উদ্দেশ্য ডিভোর্সের কথা জানানো, অনির্বাণ আর নিখিলের চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করা, নীলা যে বেঁচে আছে, এবং ভালই বেঁচে আছে, সে খবরটি দেওয়া।
তুই? পশ্চিম দিকে সূর্য উঠল নাকি আজ? নীলার কণ্ঠ শুনে নিখিল বলে।
সূর্য পুবেও ওঠে না, পশ্চিমেও ওঠে না। সূর্য যে জায়গায় আছে, সেই জায়গায়ই থাকে, অন্যদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। বলে নীলা।
তা বল, আছিস কেমন। শুনেছি তুই নাকি এক সাহেবের সঙ্গে থাকছিস!
সুনীল বলল তো! ও আমার ফোন নম্বর বা ঠিকানাও দিয়েছে নিশ্চয়ই।
নীলা জানাল, কিষানলালের সঙ্গে তার কাগজপত্রে বিচ্ছেদের ব্যবস্থার কথা। সাহেবকে নিয়ে সে সুখে আছে, শিগরি তাদের বিয়ে হবে। সুতরাং কলকাতায় কেউ যেন রটিয়ে না বেড়ায়, নীলা পতিতা হয়ে গেছে।
তোমার খবর কী দাদা? বিয়ে করছ নাকি? নীলা জিজ্ঞেস করে।
মেয়ে দেখছি। গত মাসে পাঁচটি মেয়ে দেখেছি।
পছন্দ হয়েছে কাউকে?
আরে না।
কেন?
পাঁচটিই কালো। হা কপাল।
পাঁচটি মেয়েই কালো বলে নিখিলের বিয়ে করা হয়নি। কোনও ফরসা মেয়ে পেলে তবেই নিখিল বিয়ে করবে, তার আগে নয়।
নীলা বলে, তুমি তো কালো।
পুরুষেরা কালো হলে কিছু যায় আসে না।
নীলা মনে মনে বলে, তা ঠিক পুরুষেরা কালো হলে, কুৎসিত হলে, কদাকার হলে, অসৎ হলে, নিকৃষ্ট হলে, বদমাশ হলে, দুশ্চরিত্র হলে, দানব হলে, অমানুষ হলে, লম্পট হলে, লোচ্চা হলেও কিছু যায় আসে না।
.
উৎসবের দিন
বেনোয়ার ছাব্বিশতম জন্মদিন পালন করা হবে ঘটা করে, নীলার ইচ্ছে ভোজ উৎসবে কাকে কাকে নেমন্তন্ন করবে তার একটি লিস্টি তৈরি করে প্রথম।
১ . মরুনি
২ . ফ্রেডেরিক
৩ . দানিয়েল
৪ . নাতালি
৫ . নিকল
৬ . মিশেল কজ
৭ . রিতা
৮ . মোজাম্মেল
৯ . মোজাম্মেলের বন্ধুরা (৩ অথবা ৪)
১০ . সানাল এডামারুকু
১১ . বাবু গোগিনি
১২ . বাবু গোগিনির বউ
১৩ . তারিক
১৪ . অডিল
১৫ . চৈতালি
১৬ . সুনীল
মরুনি আর ফ্রেডেরিক জানিয়ে দেয়, তারা আসছে। দানিয়েল জানায়, মঙ্গলবার বিকেলে তার ইস্কুলে যেতে হবে, সুতরাং আসা হবে না। সম্প্রতি সে নতুন একটি ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে, ওখানে সপ্তাহে তিন দিন ‘কী করিয়া সাহিত্য রচনা করিতে হয়’-এর ক্লাস করে। আর নাতালি যাচ্ছে সোলারিয়ামে, ওরও আসা হবে না।