এত নামী শিল্পী, এত বড় মাপের মানুষ পিকাসো…
নীলা বলে, বড় শিল্পী হয়তো, মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ছোট ছিলেন, ফ্রাসোয়াজ তো লিখে গেছে জীবন কেমন ছিল পিকাসোর। স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন, আর নিজের গৃহেই যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছিলেন। অলগা, মারি তেরেস, ডোরা, ফ্রাসোয়াজ, জ্যাকলিন কাকে না ঠকিয়েছেন!
বাহ তুমি তো আমাদের পিকাসো সম্পর্কে বেশ ভাল জানো।
পিকাসো তোমাদের নয়, পিকাসো স্প্যানিশদের।
ওই একই, পশ্চিমের তো!
নীলা পুবের, পশ্চিমের একবারে উলটোদিকে, নীলার স্মরণ হয়েছে।
পমপিডুর আধুনিক শিল্পকলা দেখতে গিয়ে নীলার বিশ্বাস হয়নি এগুলো আদৌ কোনও শিল্প। প্রথম যে শিল্পের সামনে এসে সে থমকায় সে একটি গোরুর মাংসের জামা, পাতলা করে মাংস কেটে মাংসগুলোকে সেলাই করে একটি জামা বানানো হয়েছে, সেই জামা একটি মেয়েকে পরিয়ে ছবিও ভোলা হয়েছে। কেবল এই নয়, একটি ছেঁড়া কাগজে পেনসিলে হাবিজাবি লেখা, ব্যাস এটিকে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে, এ নাকি শিল্প। পুরনো ছেঁড়া কাপড়, ভাঙা রেডিয়ো, ফাটা টায়ার, সিগারেটের খালি প্যাকেট, মোটকথা আবর্জনার স্তূপ থেকে জিনিসপত্র কুড়িয়ে এনে জড়ো করে বলা হচ্ছে এ নাকি শিল্প। একটি নীল ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে নীলা অনেকক্ষণ খোঁজার চেষ্টা করেছে, কোনও একটি দাগ আছে কিনা ওতে, কোনও একটি বিন্দু অন্তত, নেই, এটি নাকি শিল্প! বেনোয়াকে জিজ্ঞেস করেছে, ক্যানভাসে তো আঁকা নেই কিছু, এটি শিল্প হয় কী করে। বেনোয়া বলেছে, নিশ্চয়ই শিল্প, তা না হলে এখানে রাখা হত না! নীলা যুক্তি খুঁজে পায় না। রাখা হলেই কি শিল্প হয়? আধুনিক শিল্পের ওপর আস্থা হারিয়ে তার বরং অনাধুনিক শিল্প দেখতে ভরেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। পরদিন ল্যুভরে চোখ এবং মন জুড়োতে গিয়ে মিশরের, গ্রিসের আফ্রিকার প্রাচীন শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে নীলা বলে, এখন তো আর উপনিবেশ নেই, এই লুটের মালগুলো এখন ফেরত দিয়ে দিলেই তো হয়! যে দেশের শিল্পকর্ম সে দেশেই থাকুক।
বেনোয়ার উত্তর, আমরা রক্ষা করেছি বলে জিনিসগুলো আছে, ও সব দেশে হলে জিনিসগুলো থাকত না।
কী হত থাকলে? পোকায় খেত? নীলা বলে।
নীলা ভাবে, সম্ভব হলে এরা মাটি খুঁড়ে পিরামিডও তুলে আনত মিশর থেকে।
সপ্তাহের একটি সন্ধ্যা বেনোয়াকে নিয়ে মরুনির বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে আসে নীলা, ধনী এলাকার এভিন্যু দ্য প্রেসিডেন্ট উইলসনে মরুনির বাড়ি, বাড়িটি মরুনি তার ফরাসি বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছে।
নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার পথে বেনোয়া যখন বলেছে, মরুনির ভাগ্য খুব ভাল।
নীলা বলেছে, কেবল ভাগ্যটাই কি সব, ওর প্রতিভা ছিল বলেই ও বড় হয়েছে।
.
প্রতি সন্ধেতেই পাসকাল বাড়িতে ফোন করেছে, নীলা হ্যালো বলতেই বলেছে, আমি পাসকাল, বেনোয়া আছে? নীলা বেনোয়াকে ফোন দিয়েছে কথা বলতে, বৃহস্পতিবার রাতে পাসকালের ফোন পাবার পর বেনোয়া রু দ্য রেন-এ চলে গেছে থাকতে, ওখান থেকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে, রাতে সে আর বাড়ি ফিরছে না।
পরদিন বাড়ি ফিরে এলে নীলা দু একটি মামুলি কথার পর বলেছে, কী পাসকালের সঙ্গে শোওনি কাল রাতে?
না।
কেন?
কেন মানে?
ওকে তুমি ভালবাসো, ওর সঙ্গে শুতে তোমার আপত্তি কী?
যেদিন থেকে তোমাকে ভালবেসেছি, সেদিন থেকে কেবল তোমার সঙ্গেই শুই, ওর সঙ্গে নয়। সেই সমুদ্র পাড় থেকে আসার পর ওর সঙ্গে শুইনি।
সমুদ্র পাড়ে যখন ছিলে, তখনও তো তুমি বলতে যে আমাকে ভালবাসো।
আচ্ছা নীলা তুমি এত পেঁচাচ্ছ কেন এ সব নিয়ে। তুমি কি চাও না জ্যাকলিনের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক থাক।
নিশ্চয়ই চাই। আমি কেবল জানতে চাইছি, দুজনের সঙ্গে যৌনসম্পর্কে যেতে তোমার অসুবিধে কী? ভালবাসলে যৌনসম্পর্কে যাওয়াটা তো যৌক্তিক মনে করো, আমার সঙ্গে তাই ওই সম্পর্কে গেছ।
আমি পাসকালের সঙ্গে শুইনি, তোমার ভাল লাগবে না বলে।
আমার ভাল লাগবে না বলে তুমি নিজের ইচ্ছেকে দাবিয়ে রেখেছ? নীলা জিভে চুক চুক শব্দ করে দুঃখ করে।
আর তা ছাড়া পাসকালও চায় না আমার সঙ্গে ও সম্পর্কে যেতে।
কী করে জানো পাসকাল চায়নি? ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে? তুমি চেয়েছিলে আর ও না বলেছে, এই তো?
নীলা তুমি অতিরিক্ত কথা বলছ।
অতিরিক্ত নয়, আমার কথার উত্তর দাও, পাসকাল যদি চাইত, কী করতে?
মানে?
মানে পাসকাল যদি চাইত তোমার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করতে! তা হলে কী করতে? পাসকাল চায়নি বলে নিজের ইচ্ছেকে দমন করেছ, চাইলে তো সম্পর্কটি করতে, তাই না?
না করতাম না। কারণ আমি জানি তুমি ওর সঙ্গে শোয়াটা পছন্দ করো না।
ধরো আমি যদি পছন্দ করি?
মানে?
মানে হল আমি খুব পছন্দ করব, তুমি যদি আজ রাতে পাসকালের সঙ্গে ঘুমোও। ওকে ভোগ করো।
হঠাৎ এ ব্যাপারটা পছন্দ করছ কেন? তুমি তো ওকে সহ্যই করতে পারো না। হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরো।
আমি হিংসায় জ্বলছি ভেবে তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ। আমি এখন ভারতীয় মেয়েদের তুমি যেমন জানো, ঠিক তেমন, সহনশীল, তেমন নিষ্ঠ, কর্মঠ, এবং অস্বাভাবিক রকমের উদার।
বেনোয়া গুম হয়ে অনেকক্ষণ বসে থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। ফিরল দু বোতল ওয়াইন আর এক থোকা গোলাপ হাতে নিয়ে। নীলার হাতে দিয়ে নরম স্বরে বলল, তোমাকে আমি ভালবাসি, এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই।