ধ্যুত। মাথা ঝিমঝিম করে নীলার। মাথায় বেনোয়ার ভয় ঘাপটি মেরে আছে। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। মনে হচ্ছে কোথাও যেন কিছু ভুল থেকে যাচ্ছে। মলিনার রোগে ভোগা মলিন শরীরের মতো দেশটি তার পড়ে আছে একা, শুশ্রূষা করার কেউ নেই, নীলা মনে মনে পাখি হয়ে উড়ে যায় দেশটিতে, মনে মনে সে বৃষ্টি হয়ে ঝরে দেশটির খরায় পোড়া শরীরে। নীলার মনে হতে থাকে শেকলে সেও বাঁধা, যদি সে পারত সকল বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাথা নত করতে তার দেশটির সামনে। এই নিষ্ঠুর বিদেশ সে কেন অযথা পড়ে আছে, সে জানে না। এই দেশটিকে যত সে দেখছে, তত তার অচেনা মনে হচ্ছে, এই দেশ তাকে কী দেবে, নিরাপত্তা? কীসের নিরাপত্তা? সুখের, নাকি বেঁচে থাকার! নীলার মাঝে মাঝে মনে হয় বেঁচে থেকে কী লাভ। সুখী হয়েই বা কী লাভ।
নীলার হাতদুটিতে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বেনোয়া বলে, তা হলে তুমি কি বলতে চাও তুমি বিশ্বাস করো না যে ঈশ্বর আমাদের গড়েছেন পরস্পরের জন্য?
নীলা জানালা থেকে চোখ না ফিরিয়ে বলে, না।
» ৮. এখানেই শেষ নয়
সপ্তাহটি নীলার কেটে যায় সংসারী গৃহবধুর মতো। সকাল সাতটায় রেডিয়োর খবর প্রতিদিন বেনোয়াকে ঘুম থেকে জাগায়, সঙ্গে নীলাকেও। একবার সে বলেছিল, রেডিয়োটা এমন বোমার মতো বেজে ওঠে, যে আঁতকে উঠি। ঘুম পুরো হয় না। বেনোয়া বলেছে, খুব বেশি ঘুমোও তুমি, বেশি ঘুমোলে শরীর ভারী হয়ে যায়। শরীর ভারী হয়ে যাবার ভয়ে, নীলা ঘুম থেকে উঠতে থাকে রেডিয়োর শব্দে। উঠে বেনোয়ার জন্য সকালের খাবার তৈরি করতে রান্নাঘরে ঢোকে। এক একদিন একেক রকম প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে সে, বেনোয়ার রুচি পরিবর্তনের জন্য। ঠোঁটে চুমু খেয়ে ও আপিসে চলে গেলে নীলা ঘরদোর গোছায়, কাছের দোকান থেকে বেনোয়া যা যা ভালবাসে তা কিনে এনে রান্না করে, আর ঘড়ি দেখে বেনোয়ার ফিরে আসার, ফোনের শব্দ হলে লাফিয়ে যায় ফোন ধরতে। বেনোয়া জিজ্ঞেস করে কী কী করেছে নীলা সারাদিন, নীলা বিস্তারিত বর্ণনা করে। শেষে জিজ্ঞেস করে, আমাকে ভালবাসো? নীলা বলে, হ্যাঁ বাসে। দিনে বেশ কয়েকবার বেনোয়ার এই নিশ্চিতি দরকার হয়। সন্ধেয় ঘরে ফিরে বেনোয়া প্রথম নীলাকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে নেয়, তারপর টেলিভিশন খুলে বসে, খাবার ডাক পড়লে খেতে আসে। টেলিভিশনে এর মধ্যে একদিন ভারতের ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখিয়েছে, বেনোয়া লাফিয়ে উঠেছে, এসো এসো ভারত ভারত। নীলাকে দেখতে হয়েছে সোনাগাছির মেয়েদের মিছিল। ওদের অধিকার আন্দোলন নিয়ে মূলত তথ্যচিত্রটি। বেনোয়া দেখেছে আর বলেছে, ইস তোমাদের দেশে এত বেশ্যা! নীলা অন্য কথা পেড়েছে বেনোয়ার মন ফেরাতে, আজ তোমার জন্য শামুক কিনেছি। চেখে দেখার আগেই বেনোয়া উমমম উমমম করেছে। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত শুনিয়ে বেনোয়াকে চমকিত করতে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশি চাপিয়ে দিয়ে বেনোয়ার উল্লসিত হওয়া দেখতে তাকিয়ে থেকেছে নির্নিমেষ, বেনোয়া বলেছে, নীলা তুমি কিছু মনে কোরো না, আমি এটা পালটে দিচ্ছি, বলে ফরাসি গানের একটি সি ডি চাপিয়েছে, কেন তুমি চৌরাশিয়ার এমন ভাল বাঁশি পছন্দ করলে না? বেনোয়া দুঃখিত স্বরে শুধু বলেছে, ওয়েল নীলা, ইটস নট মাই কাপ অব টি। বেনোয়া তার ফরাসি কাপ অব টি একাই পান করেছে, একাই পান করে। নীলাকে একদিন হাতে খেতে দেখে বেনোয়া বড় বড় চোখ করে যেন আফ্রিকার জঙ্গল দেখছে তাকিয়েছিল বলে নীলা হাত ধুয়ে কাঁটা আর ছুরিতে খেতে শুরু করে, দেখে বেনোয়া সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, হাতেই খাও না, লজ্জা কীসের, আমরা আর কবে থেকে কাঁটা ছুরিতে খাই! আমাদের আদি পুরুষেরা তো হাতেই খেত। ধরো এক হাজার বছর আগে, তখন কি আর কাঁটা ছুরি ছিল? বেনোয়ার পছন্দের খাবার সাজিয়ে দেয় নীলা টেবিলে, প্রতি রাতেই। বেনোয়া খেতে খেতে মন্তব্য করে, কোন খাবারটি কেমন হয়েছে। কাল যেটা করেছিলে সেটা বেশ স্বাদ হয়েছিল। কোনটা? ওই মাংসের কালিয়াটা? হ্যাঁ। নীলা পরদিন আবার মাংসের কালিয়া করে। রাতে বিছানায় ঘুমোতে গিয়ে নীলার শরীর নিয়ে বেনোয়া মেতে ওঠে। বেনোয়ার নতুন একটি আগ্রহ জন্মেছে, মৈথুনের পুরোটা সময় জুড়ে সে নীলার কন্ঠে বাংলা শুনতে চায়, তোমাকে ভালবাসি থেকে শুরু করে তোমাকে আরও চাই, আরও গভীরে, এরকম যত যৌনআবদার বা সুখার্তনাদ আছে, সব। বেনোয়া মানে বুঝবে না, কিন্তু তার শুনতে অন্যরকম লাগবে, অন্যরকম আনন্দ নাকি সে পায়ও এতে। বেনোয়াকে আনন্দ দিতে নীলা তাই করতে শুরু করে, এবং নিজের কাছে নিজের কণ্ঠকে অদ্ভুত লাগে তার, কারণ বাংলায় এ সব বাক্য বলার অভ্যেস তার নেই। নীলা অভ্যেস ঝেড়ে ফেলার চর্চা শুরু করে, রান্না করতে করতে, কাপড় ধুতে ধুতে, ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে, জানালার কাচ মুছতে মুছতে। প্রায়ই বেনোয়া বলে ভারতীয় মেয়ের শরীরের আনাচে কানাচে অন্যরকম রহস্য, এই স্বাদই অন্য। এই অন্যরকমটি বেশ লাগে বেনোয়ার। পাসকালের সঙ্গে মিলনে ঠিক যেন এরকম হয় না। নীলার পুলক হয় শুনে যে অন্যরকম এক আনন্দ সে বেনোয়াকে দিতে পারছে, পাসকাল যে অন্যরকমটি দিতে পারে না। তারপর ঝড়ো রতি শেষে শুভরাত বলে চুমু খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া। রেডিয়োর খবরে আঁতকে উঠে ভোরের চোখ খুলে সুপ্রভাত বলে আরও একটি চুমু খাও। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন চুমুগুলো রপ্ত করতে নীলার যদিও সময় লেগেছে, এ সপ্তাহে সে নিষ্ঠার সঙ্গে ফরাসি চুমু সংস্কৃতি পালন করেছে, যত হোক ফরাসি প্রেমিক নিয়ে সংসার করতে গেলে এটি না করলে যে চলে না সে জ্ঞান তার আছে। সপ্তাহের একটি বিকেল কাটে পিকাসো জাদুঘরে আর পমপিডুতে। পিকাসোর আঁকা ছবি দেখে নীলা কোনওরকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। বেনোয়া জিজ্ঞেস করলে শুধু বলে, দুটো মেয়ে সমুদ্রপাড়ে দৌড়োচ্ছে, এটি ছাড়া আর কোনও ছবিই তার ভাল লাগেনি। শুনে বেনোয়া বলেছে, বুঝতে গেলে শিল্পবোদ্ধা হতে হয়। নীলা শিল্পবোদ্ধা নয়, তাই সে পিকাসোর দড়ি, ছেঁড়া কাপড় আর পেরেক বসানো শিল্পগুলো দেখে মূর্খের মতো তাকিয়ে থেকেছে।