বোতল অর্ধেক খালি হলে কিষান খেতে বসে। স্বামীকে থালায় ভাত তরকারি বেড়ে দিয়ে চুক চুক করে দুঃখ করে নীলা, রান্না ভাল হয়নি বলে। অপরাধী মুখ করে সে বসে থাকে সামনে। খেতে খেতে কিষান বলে, শত হলেও বউয়ের হাতের রান্না।
নীলা জানে স্ত্রীর হাতের রান্না খেতে সব স্বামীই পছন্দ করে। অনির্বাণ যদিও মলিনার রান্নার ক্রটি সকাল বিকাল আবিষ্কার করতেন, কিন্তু চিত্রার হাতে রান্না কিছুতে মুখে তুলতেন না। একবার মলিনা জ্বরে পড়ে শুয়ে রইলেন, চিত্রা রান্নাবান্না করল, নিখিল খেল, নীলা খেল, কিন্তু অনির্বাণ খাবেন না। মলিনাকে জ্বর গায়ে নিয়ে রাঁধতে হল, তবে অনির্বাণ খেলেন। এতে অনির্বাণই যে কেবল তৃপ্তি পেয়েছিলেন তা নয়, মলিনাও পেয়েছিলেন।
কিষান খাওয়া শেষে বলে আমি বাচ্চুকে, রেস্তোরাঁয় যে ছেলেটি রাঁধে, একদিন বাড়িতে পাঠিয়ে দেব রান্না শেখাতে।
নীলা হেসে বলে, রান্নাও অভ্যেসের ব্যাপার।
.
রান্না যেমন অভ্যেসের ব্যাপার, স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোনোও। বিয়ের পর প্রথম যখন কিষান শুয়েছিল নীলার সঙ্গে, সারারাত হাঁসফাঁস করেছে নীলা, হাত পা ছুড়ে শোয়া, এপাশ থেকে ওপাশে গড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না বলে। ধীরে ধীরে বেশি অর্ধেক জায়গা ছেড়ে দেবার, হাত পাকে শেকলবন্দি করার এবং নাক ডাকার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতে অভ্যস্ত হয়েছে সে, এটিকে ধাতস্থ করেছে ধীরে, এটিই মজ্জাগত হবে তার।
কিষান যখন শাড়ি সরিয়ে হাঁ মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছে বুকে, আহ্লাদি গলায় বলে নীলা, আমি কিন্তু কাল একটু রাস্তায় হাঁটতে চাই।
কেন?
এমনি?
এমনি এমনি কেউ বেরোয় নাকি?
দূরে যাব না। কাছেই।
এই নোংরা এলাকায় কী হাঁটবে?
নোংরা বলছ? এমন ঝকঝকে।
একা হাঁটবে? হারিয়ে যাও যদি। সামনের শনিবার আমি সময় পাব, তখন তোমাকে ইফেল টাওয়ার দেখাতে নেব।
এদিকে ইফেল টাওয়ারের স্বপ্নে নীলা বিভোর, ওদিকে কিষান পরমানন্দে নীলার টাওয়ার এর চুড়োয়..
.
০২.
ছদিন অপেক্ষা করার পর সামনের সেই শনিবার এল। নীলাকে গরম জামা জুতো কিনে দিয়ে ইফেল টাওয়ার দেখিয়ে মঁপারনাসে তাজমহল রেস্তোরাঁয় থামে কিষান। মালিকের বউ এসেছে, ছড়িয়ে পড়ে খবর।
কালো সুট নেকটাই মোজাম্মেল এক গাল হেসে এগিয়ে আসে দিদি কী খাবেন বলুন, চা কফি, নাকি ঠাণ্ডা কিছু?
নীলা চা খাবে, কারণ তার মনে হচ্ছে বছর চলে যাচ্ছে তার চা খাওয়া হচ্ছে না। চায়ের তৃষ্ণা চা ছাড়া আর কিছুতে মেটে না।
কী চা, ভারতীয় চা, না কি কালো চা?
নীলা অবাক হয়, ভারতীয় চা কী রকম শুনি?
দুধ দিয়ে, এলাচ লবঙ্গ দিয়ে। নীলা ওয়াক থু করে, সে চায়ে দুধই নেয় না, আবার এলাচ লবঙ্গ।
চা এল। এক দঙ্গল বাঙালি ছেলেও এল। রান্না ফেলে বাচ্চুও। এদের কারও বাড়ি যশোর, কারও রংপুর, কারও বরিশাল। হৃদয়ে নীলার খুশির জোয়ার ওঠে, বলে, আমার বাবার বাড়ি ছিল ফরিদপুর। দেশভাগের সময় বাবা পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এলেন, আর ফিরে যাননি।
ছেলেগুলোও নীলাকে, যেন ওদের পাড়াতুতো বোন, মেঘনা যমুনা পদ্মার গল্প শোনাল। দেখে কিষান ক্যাশবাক্সের সামনে থেকে চেঁচায় বাঙালির আড্ডা হচ্ছে তাই তো! এই বাঙালির মতো অলস জাতি এ জগতে নেই। কেবল খাও, ঘুমোও আর আড্ডা দাও। চলো চলো।
আরে চাটা খেতে দাও তো। নীলাও গলা তোলে। বাঙালি পেলে এই হয়, গলায় জোর বাড়ে। কেবল কি গলায়, নীলা অনুমান করে, খানিকটা মনেও।
চা খেতে খেতে নীলা জানল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে লেখাপড়া করেছে, সর্বোচ্চ ডিগ্রিও নিয়েছে, ঢাকায় চাকরি জোটেনি বলে উপার্জনের আশায় মোজাম্মেল ফ্রান্সে এসেছে আজ তিন বছর। গলা কাটা পাসপোর্ট নিয়ে এ দেশে এসেছে।
এ আবার কী জিনিস?
এ হচ্ছে অন্যের পাসপোর্টে ছবি থেকে গলা কেটে নিয়ে নিজের গলা বসিয়ে দেওয়া।
নীলা শিউরে ওঠে।
মোজাম্মেল বলে, কী আর করা, বিদেশের ভিসা তো পাব না..ভিসাঅলা পার্সপোর্ট কিনতে পাওয়া যায়, জমিজমা বাবার যা ছিল বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকায় সে পাসপোর্ট কিনে, তারপর…
নীলা উৎসুক।
তারপর ফ্রান্সে এসে কাজ শুরু করলাম।
কী কাজ?
রাস্তায় গোলাপ বিক্রি।
পদার্থবিজ্ঞান পড়ে ফুল বিক্রি?…কেন এখানে ভাল কোনও চাকরি পেলেন না? উৎকণ্ঠায় কাঁপে নীলার স্বর।
মোজাম্মেল হেসে বলল, আমাদের লেখাপড়ার কোনও মূল্য নেই এখানে। ঝাড়ুদারের চাকরিও করেছি কিছুদিন।
এই রেস্তোরাঁয় কাজ পাওয়ার আগে মোজাম্মেল কমপিউটার বাক্সবন্দি করার কাজ করত। পয়সা কম জোটে এ সব কাজে, কারণ বৈধ কাজ নয় এ সব। কাগজ না হওয়া তক চাকরি বাকরি করার অনুমতি দেয় না এ দেশের সরকার। যা করতে হয়, লুকিয়ে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে। তাই অবৈধ। কাগজ সম্পর্কে কৌতূহল বাড়ে নীলার। কেবল মোজাম্মেলই নয়, জুয়েল নামের একটি বাচ্চা বাচ্চা মুখের ছেলেও এই শব্দটি উচ্চারণ করেছে। নীলা অনুমান করে সবাই যে দুর্লভ জিনিসটির অপেক্ষা করছে রাতদিন, যেটির জন্য প্রার্থনা, যেটির জন্য প্রাণ পেতে বসে থাকা, যেটি পেলে জীবনের অন্ধকার, অসুন্দর, অবিন্যাস দূর হবে, সে হল কাগজ।
কী এই কাগজ।
এ দেশে থাকার অনুমতি।
নীলার কৌতূহল দানোর মতো বাড়ে। মোজাম্মেল অসংকোচে বলে যায়, এদেশ থেকে দুবার তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, শেষে মামলা করলাম থাকার কারণ দেখিয়ে, ঝুলে আছে মামলা, যদ্দিন ঝুলবে, তদ্দিন থাকতে পারব…