নীলা হঠাৎ হেসে ওঠে।
কী ব্যাপার হাসছ কেন?
মাঝে মাঝে আমার খুব হাসি পায় বেনোয়া। মানুষের অবস্থার কী পার্থক্য দক্ষিণে আর উত্তরে। কোথাও সম্পদের আধিক্য, কোথাও অভাব। কেউ ধোঁকে, কেউ আনন্দ করে। পুরো ব্যাপারটা কেমন কৌতুক বলে মনে হয়।
নীলা আবার অন্যমন।
বেনোয়া নীলার ধ্যানে টোকা দিয়ে বলে, কী ভাবছ এত।
না তেমন কিছু না।
তেমন কিছু না মানে। আমাকে বলো।
বলার মতো কিছু না।
বলার মতো না হলেও বলো।
বেনোয়ার কণ্ঠে দাবি, প্রেমিকের দাবি। প্রেমিকা অন্যমনে কিছু ভাবলেও তা শোনার বা জানার দাবি সে করতেই পারে, কারণ নীলা বেনোয়াকে জীবন সঁপে দিয়েছে। জীবন সঁপে দিলে শরীর যেমন দেওয়া হয়, মনও দিতে হয়, রেলের কামরায় বসে ভাবা টুকরো টুকরো উদাসীন ভাবনাগুলোও।
জঁ পল সার্ত্রের কথা ভাবছি। নীলা বলে।
আমাদের জঁ পল সার্ত্রের কথা?
হ্যাঁ তোমাদের জঁ পল সার্ত্রের কথা।
বেনোয়া জোরে হেসে ওঠে, আমি ভাবলাম তুমি বুঝি তোমাদের দরিদ্র কৃষকের কথা ভাবছ।
নীলা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে, সার্ত্র বলেছেন জীবনের কোনও অর্থ নেই, কিন্তু একে অর্থময় করে তুলতে হবে। কী করে অর্থময় করতে হয় বলো তো? কোনও দরিদ্র দেশে দরিদ্র পরিবারে দরিদ্র ছেলে বা মেয়ের জন্ম হল, লেখাপড়া করার সুযোগ জোটেনি, অনাহারে অভাবে অসুখে কষ্ট পাচ্ছে, চব্বিশ ঘণ্টা তার পরিশ্রম করতে হয় এক থালা ভাত জোটাতে, তার হয়তো বিরাট প্রতিভা ছিল বড় একজন বিজ্ঞানী হবার, বা বড় একজন লেখক হবার, বা বড় একজন দার্শনিক হবার। কিন্তু প্রতিভাকে সে কাজে লাগাবে কী করে, বলো? জীবনকে অর্থময় করার তার সুযোগ কোথায়? পেটে যার খাবার নেই, গায়ে যার কাপড় নেই, মাথা গোঁজার যার ঠাঁই নেই, তার কাছে জীবন মানে কি কেবলই যন্ত্রণা নয়?
নীলা মলিনার কথা ভাবে, মলিনার কি কোনও সাধ্য ছিল তাঁর নিজের জীবনকে কোনও অর্থ দেবার? স্বামীর সংসারে বন্দি ছিলেন মলিনা, অদৃশ্য শেকল ছিল মলিনার শরীরে মনে, সামাজিক শেকল, সেই শেকল ছেঁড়ার নিয়ম তাঁর জানা ছিল না। এরকম লক্ষ লক্ষ মলিনা ধুঁকে মরছে সংসারে, জানে না কী করে বাঁধন ছিঁড়তে হয়।
বেনোয়া আবারও হেসে ওঠে, বলে, কী সব আবোল তাবোল বকছ? সবাই তো আর একরকম করে জীবনের অর্থ তৈরি করে না। আমার জীবনের অর্থ হচ্ছে জ্যাকলিন। আমার বাবা মা ধনী ঘরের সন্তান ছিলেন না, তাঁরাও প্রচুর সংগ্রাম করেছেন। সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, আমি তাঁদের জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছি, অর্থ দিয়েছি। আর তা ছাড়া পরকালে কৃতকর্মের ফল তো ভোগ করতেই হবে। জীবন অর্থহীন হবে কেন?
নীলা জোরে হেসে ওঠে।
কী হাসছ যে?
নীলা হাসতে হাসতেই বলে, তুমি পরকালে বিশ্বাস কর?
নিশ্চয়ই। তুমি কর না?
না।
কেন তোমাদের ধর্মে তো স্বর্গ নরক আছে! বেনোয়া বলে।
বহুকাল আগে এক বাঙালি লেখক লিখে গেছেন স্বর্গ নরক নিয়ে, কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর, মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর। নীলা হাসতে হাসতে বলে।
বেনোয়া সোজা হয়ে বসে, গম্ভীর কণ্ঠ তার, তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর না।
নীলা স্পষ্ট স্বরে বলে, না।
আশ্চর্য। বেনোয়া গা ছেড়ে দেয় আরাম চেয়ারে।
ভারতবর্ষের খ্যাতিই হচ্ছে এর অধ্যাত্মবাদ। ভারতে আদিকাল থেকে এরই চর্চা হয়েছে, এখনও এরই চর্চা হচ্ছে, এ সে ইস্কুলের বইয়েই পড়েছে জানাল।
নীলা বলে, প্রাচীন ভারতের চার্বাক দার্শনিকের কথা তোমার ইস্কুলের বইয়ে লেখেনি? তখনকার জনপ্রিয় দর্শনের নাম ছিল লোকায়ত। লোকায়িতরা আত্মা মানত না, ঈশ্বর মানত না, স্বর্গ নয়, নরক নয়। বহুকাল ধরে ভারতবর্ষ ইংরেজদের শাসনে থেকেছে। ইংরেজরা আমাদের বোঝাতে চেয়েছে যে আমরা ভারতবাসীরা, নেহাত খাটো ধরনের মানুষ। সভ্যতার শিক্ষায় জ্ঞানে বুদ্ধিতে কোনওদিক থেকেই ওদের সমান নই, তাই আমাদের পক্ষে দাসত্বটাই স্বাভাবিক। অবশ্যই এ সব মিথ্যে। ভারতবাসীকে ঠকাবার জন্যই এ সব বলা হচ্ছে। এ কারণেই, ভারতবর্ষে যখন স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হল, কিছু কিছু জাতীয়তাবাদী পণ্ডিত দেশের অতীত গৌরবটাকে খুব বড় করে দেখাবার চেষ্টা করলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস খুঁড়ে প্রমাণ দেখাতে লাগলেন কত মহান, কত উচ্চ আমাদের সভ্যতা। পশ্চিমের বিজ্ঞানবাদ বা বস্তুবাদের বিপরীত ভাববাদ দেখিয়ে বলতে লাগলেন, অতীতে মুনি ঋষিরা বলে গেছেন সংসারটা হচ্ছে অনিত্য, মায়া, মিথ্যা। সংসারের কিছু স্থূল সুখভোগকেই পুরুষার্থ মনে করা নেহাত স্থূলবুদ্ধির লক্ষণ। এ সব হচ্ছে আত্মমর্যাদার কারণে আর একেই পশ্চিমিরা ভেবে নিয়েছে, ভারতের সত্যিকার পরিচয়।
এটুকু বলে নীলার আশঙ্কা হয় এই বুঝি বেনোয়া এখন প্রশ্ন করবে, এতই যদি বস্তুবাদের কদর ভারতবর্ষে, কই, দেশ তো এখনও দরিদ্রই রয়ে গেছে। অর্থনীতির অবস্থা এমন করুণ কেন? মানুষ কেন দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে? নীলা সম্ভাব্য প্রশ্নটির একটি উত্তর দাঁড় করায়, কারণ দুশো বছরের ইংরেজ শাসন অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। প্রশ্ন, ইংরেজ তো গেছে, পঞ্চাশ বছরের বেশি হয়ে গেল। উত্তর, পঞ্চাশ বছর খুব কম সময় দেশকে গড়ার জন্য। বেনোয়া যুক্তি দেখাতে পারে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জার্মানিতেও কিছু ছিল না, পঞ্চাশ বছরে ইয়োরোপের সবচেয়ে ধনী দেশ জার্মানি। নীলা তখন আমেরিকার মার্শাল প্ল্যানের কারণটি দেখাবে।