বুঝতে চেষ্টা করছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলা। ফুসফুস ভরে শ্বাসের বাতাস সে সংগ্রহ করেছে। কিছু খরচ করলে ক্ষতি নেই।
ইশটিশনে বেনোয়ার বাবা দাঁড়িয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে। দুজনকে তুলে সোজা বাড়ি। বাড়িতে বেনোয়ার মা স্বাগতম জানালেন বেনোয়া আর তার প্রেমিকাকে, গালে গাল লাগিয়ে চকাস চকাস চুমু। বেনোয়ার মাকে নীলা শাশুড়ি জ্ঞান করে মা বলে ডাকতে যাচ্ছিল, শুধরে মাদাম দুপঁ বলে। মাদাম করিন দুপঁ ছোটখাটো ভারী শরীরের হাসিখুশি মধ্যবয়সি, কারখানার শ্রমিক ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। আর মসিয়ে দুপঁ নীলাকে পাশে বসিয়ে নিজের জন্মের কাহিনী বলে নেন প্রথম, তিনি হচ্ছেন মাঝ চল্লিশ দশকের বেবি বুম-এর একজন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে সৈন্যরা ঘরে ফিরে বউদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যা ঘটিয়েছিল ইয়োরাপে, তিনি তার ফল। পনেরো বছর বয়সে করিনের মতো তিনিও কারখানার কাজে ঢুকেছিলেন, পরে ভাল লাগে না বলে চলে গেলেন মারসেইয়ে, ওখানে জাহাজে কাজ করলেন দু বছর, তারপর ট্যাক্সি চালালেন কিছুদিন, সে কাজ ছেড়ে আঙুর চাষ করলেন আলসাসে, তাও একসময় ভাল লাগেনি, ছেড়ে পুলিশ হলেন, কোমরে মাঝে মাঝে ব্যথা হয় বলে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। বেশ আছেন এখন, খান দান, ঘুমোন, কম্পিউটারে তাস খেলেন, দামি পাইপে তামাক টানেন, আর একটি পর্স গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখেন। চারটে গেলাসে পতো ঢেলে দিয়ে জুতোর একটি বাক্স আনলেন, বাক্সের ভেতর রাজ্যির ছবি। কোনটি ঠাকুরদা, কোনটি ঠাকুরদার বাবা, ঠাকুরদার ঠাকুরদা ইত্যাদি তো দেখালেনই, কয়েকশো আত্মীয়র ছবিও দেখালেন, আর শেষে বেনোয়ার ন্যাংটোকালের কিছু ছবি। আত্মীয় যারা বেঁচে আছে, তাদের সঙ্গে হঠাৎ কোনও বিয়ে বা সৎকারউৎসবে দেখা হয়, এরপর যে যার জীবনে চলে যায়। বেনোয়াই এ বাড়িতে এসেছে আড়াই বছর পর। বেনোয়া বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তেরো বছর বয়সে। লেখাপড়া করেছে এক ক্যাথলিক ইস্কুলে। তারপর বাকেলেরিয়া পাশ করেছে। সরকারই খরচ চালিয়েছে লেখাপড়ার। বাবা মার সঙ্গে যা যোগাযোগ হত, বেশির ভাগই চিঠিতে। পাসকালের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর ওকে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছে, বেনোয়ার বাবা মা পাসকালকে খুবই পছন্দ করেন, জ্যাকলিন জন্ম নেওয়ার পর আবার এসেছে, আর এবার নীলাকে নিয়ে। প্যারিস থেকে মাত্র এক ঘণ্টার পথ, অথচ বেনোয়ার বাবা মাকে দেখতে আসা হয় না, ছুটিছাটায়ও আসা হয় না। জীবন যার যার তার তার। কারও ইচ্ছে নেই অতীত নিয়ে পড়ে থাকার। মসিয়ে এবং মাদাম দুপঁর আলাদা জীবন আছে, ছেলেমেয়েকে বারোত্তীর্ণ করে দিয়েছেন, দায়িত্ব পালন শেষ। সন্তান যদি শারীরিক বা মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ না হয়, তবেই বিরক্ত কম করবে। কোনও সুখবর যদি থাকে, দূর থেকে একবার ফোনে বা চিঠিতে জানিয়ে দিলেই ওঁরা সন্তুষ্ট। বেনোয়ার নতুন প্রেমও মসিয়ে এবং মাদাম দুপঁর জন্য সুখবর। বেনোয়া নিজে সুখবরটি বয়ে এনেছে। নীলা দেখতে সুন্দরী কি পেঁচি, নীলার আচার ব্যবহার বানরের মতো নাকি মানুষের মতে, এ তাঁরা বিচার করছেন না। নীলা যে রকমই হোক, তাঁদের পুত্রধন একে নিয়ে সুখী, সেটিই বড় কথা। বেনোয়া যদি এক শাকচুন্নি এনে বলত, এর প্রেমে আমি পড়েছি, একে নিয়ে আমি আনন্দে আছি, মসিয়ে দুপঁ শাকচুন্নির গেলাসে পর্তো ঢেলে দিতেন, এবং জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা শেষে জুতোর বাক্সও আনতেন সামনে। অন্যের পছন্দের ওপর নাক এরা বাঙালির মতো গলায় না। বাঙালি তার ভোঁতা নাক আদিকাল থেকে গলাচ্ছে, যদি নাক গলালে নাকের কিছু ক্ষয় হত, নাক বলতে বাঙালির সম্ভবত আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না। পাঁচ থেকে সাত বছর বয়স অব্দি বেনোয়া যে কীর্তিকাণ্ড করেছে সোৎসাহে তার বর্ণনা করে যান বেনোয়ার বাবা মা। গল্পে গল্পে যা হয়, অরলেওঁ থেকে শেষ রেলগাড়িটি চলে যায় প্যারিসের দিকে, সুতরাং সে রাত থেকে যেতে হয়। বেনোয়া ছোটবেলায় যে ঘরটিতে থাকত, সে ঘরে ছোট বিছানা, ছোট টেবিল, ছোট আলমারিতে ছোট ছোট কাপড় চোপড় এখনও সাজানো, সেই ঘরের বিছানায় নীলাকে নিয়ে বাকি রাত স্মৃতি ও সঙ্গমে পার করে বেনোয়া। শীৎকারের তীব্র শব্দ, নীলা অনুমান করে, বাকি মানুষদুটোর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বেনোয়া পরোয়া করে না।
ভোরবেলা অরলেওঁ ছেড়ে জন দার্কের স্মৃতি ছড়ানো শহর ছেড়ে, প্রাণোচ্ছল দুপঁ দম্পতি ছেড়ে প্যারিসের পথে নীলা রেলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে পরিচ্ছন্ন গ্রামগুলোর দিকে। দিগন্ত বিস্তৃত খেত, হঠাৎ হঠাৎ খেতের কিনারে খামারবাড়ি, হৃষ্টপুষ্ট গাভীদের হৃষ্টপুষ্ট দুধের ওলান। কৃষকেরা মাঝে মধ্যে গাড়ি করে সাঁ সাঁ ছুটে যাচ্ছে, হাতে বিয়ারের কৌটো, আনন্দে উৎসবে মেতে আছে। কেউ গোরু চরায় না খেতে, মেশিন বীজ ছড়ায়, মেশিন ফসল কেটে নেয়, মেশিন জড়ো করে। শহর কলকাতা থেকে বেরোলেই নীলা দেখে শীর্ণ গোরু নিয়ে শীর্ণ কৃষকেরা লাঙলে জমি চাষ করে, হাতে ফসলের চারা বোনে, হাতে ফসল কাটে। সারা বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর দুবেলা পেট পুরে খাবার মতো খাবার জোটে না। আর এদেশে কৃষকদের সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেয় ফসল না ফলানোর জন্য, দুধ না উৎপাদন করার জন্য, ভেড়া বা শূকর না বাড়ানোর জন্য। এত ফসল, এত দুধ, এত মাংসে বাজার উপচে পড়ে। এ দেশে উৎপাদন ঘটালে যে খরচা হয় তার চেয়ে অনেক কম খরচায় অন্য দেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা যায়। কৃষক গোঁফ পাকাতে পাকাতে হয়তো হাঁক দিল, আমার যে জমি আছে, ওতে ফসল ফলালে বছরে দশ লক্ষ টাকা আয় হবে, সরকার বলবে তোমাকে আমি কুড়ি লক্ষ টাকা দেব বছর বছর, ফসল ফলিয়ো না।